রঙ্গলালের কন্ঠে ‘আহা ! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’

মিয়া মনসফ

মিয়া মনসফ

মিয়া মনসফ; উপ-সম্পাদকীয় : গতকাল মাওয়া ঘাটে সন্ধ্যার একটু আগে পৌঁছেছে রঙ্গলাল। উদ্দেশ্য পদ্মাসেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে জাজিরায় যে জনসভা হবে সেখানে অংশ নেয়া। অর্থাৎ জাজিরা প্রান্তের জনসভায় অংশ নিয়ে ইতিহাসের অংশ হতে চায় রঙ্গলাল। গতকাল ছুটির দিনেই সে রওনা দেয় জাজিরার উদ্দেশ্যে। এবার রঙ্গলাল হাতে কিছু টাকা হাতে নিয়ে বের হয়ে। এই টাকা ধার করা টাকা। রঙ্গলালের বউয়ের বারণ সত্ত্বেও সে যাবেই পদ্মাসেতুর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ! 

জনসভায় যথাসময়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আগের দিনই রওনা হলো রঙ্গলাল। একরাত জাজিরা প্রান্তে রাত যাপন করার প্রস্তুতি নিয়ে বাসা থেকে বের হয় রঙ্গলাল। ওই এলাকায় বন্ধুবান্ধব আছে। রাত যাপন করতে কোন সমস্যা হবেনা রঙ্গলালের। 

ধোলাই খাল পৌঁছে অপেক্ষা করে একটু বিশ্রাম নেয়। ফুটপাতে বসে ভাবছে কিভাবে যাবে! আগেরবারের মতো মাওয়ামুখি কোন লোকজনকেও পাচ্ছেনা। মাওয়া ঘাটের দিকে কাউকে যেতেও দেখছেনা। বড়ই দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় রঙ্গলাল। কিন্তু রঙ্গলাল কিভাবে যাবে তা ভাবতে ভাবতে একটি লোকাল বাস মাওয়ার পথ ধরে যেতে দেখে। উঠে পড়ে সেই বাসে। বাসের হেলপার রঙ্গলালকে দেখে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু রঙ্গলাল কিছুতেই নামে না। একজন বাসযাত্রী বাসের হেলপারকে ধমক  দিয়ে বলে এই! তুমি ওকে ধাক্কা দিচ্ছ কেন ?

হেলপারের কর্কশ উত্তর, আরে ভাই ওও তো ভাড়া দিবার পারবো না! ওরে বিনা ভাড়ায় নিমু কেন ?
বাসযাত্রী বললেন, ওর ভাড়া আমি দেবো। তুমি ওকে তুলে নাও। 

বাসের হেলপার আর কিছু বললোনা। বসার সিট না পেয়ে রঙ্গলাল বসে পড়লো ইন্জিন বক্সের উপর। 
কী খুশী রঙ্গলালের চোখেমুখে। কাল পদ্মাসেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আর কোন সমস্যা হবেনা। এই খুশিতে রঙ্গলাল গুণগুন করে গান গায়- ‘আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!’

বাস দ্রুত গতি এগিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে নানান রকম ফেস্টুন। উদ্বোধনের নানান রকম ব্যানার। স্থানীয় ও জাতীয় নেতাদের ছবিসহ পোস্টার। বাসের ভেতর থেকে সেসব ব্যানার ও ফেস্টুনের লেখাগুলো বানান করে করে পড়তে পড়তে বাস দ্রুত ছুটছে মাওয়ার দিকে। 

মাওয়া ঘাটে পৌঁছে রঙ্গলাল দেখতে পায় পুলিশবাহিনীর সদস্যরা চারদিকে সতর্ক পাহারায়। রঙ্গলাল যাবে পদ্মাসেতুর ওপারে। ওপারে যাবার একমাত্র উপায় লঞ্চ বা স্পীডবোট।

কিন্তু স্পীড বোট ও লঞ্চের তেমন নড়াচড়া নেই। আবারো দুশ্চিন্তা ভর করে রঙ্গলালের উপর।কিভাবে ওপারের মাওয়া প্রান্তে যাবে ভেবে পায়না। মাওয়া ঘাটে নদীর পাড় ধরে হাটতে থাকে রঙ্গলাল। 

সুর্য্ তখন পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। মাঝে মাঝে সূর্য্ মেঘের ফাঁকে মুখ লুকায়।  এর মধ্যে একটি লঞ্চ এসে ভীড়ে। জাজিরা প্রান্ত থেকে এসেছে মাওয়া প্রান্তে। এই লঞ্চ আবার যাবে জাজিরা প্রান্তে।রঙ্গলালের মতো আরো অনেকে নদীর ঘাটে ওপারে যাবার অপেক্ষায়। আর দেরি করে লাভ নেই। এক লাফে উঠে পড়ে লঞ্চে। দেখতে দেখতে মানুষে পরিপূর্ণ। সবাই লঞ্চ ছাড়লো জাজিরার উদ্দেশ্যে। লঞ্চ চলছে ঢেউয়ের তালে তালে। আর লঞ্চের আরোহীরা সবাই তাকিয়ে আছে পদ্মাসেতুর দিকে। সবাই পদ্মাসেতু নিয়ে গল্পে মগ্ন। রঙ্গলাল সবার কথা শোনে।

এক লঞ্চ যাত্রী আলাপরত অন্যদেরকে বলছে, আমগো পরধান মন্ত্রী বাপের বেটি। বিশ্বো ব্যাংক ট্যাহা দ্যায় নাই। তয় কি অইছে। আমগো ট্যাহা দিয়া পদ্মাসেতু বানাইয়া ফেলাইছে। ঐ দেহো, কী সুন্দর পদ্মা সেতু? কাইল থেইক্যা আমরা ঐ সেতু দিয়া যামু। ৬ মিনিট সময় লাগবো। এই কথা শুইন্যা রঙ্গলাল খুশিতে গান ধরছে- আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।

প্রায় দু’ঘন্টায় ওপারে পৌঁছে যায় মানুষ ভর্তি লঞ্চ। এই মানুষগুলো জাজিরা এলাকার বাসিন্দা। ঢাকায় কেউ চাকরী করে আবার কেউ ব্যবসা করে।পদ্মাসেতুর উদ্বোধনী জনসভায় অংশ নেবে ওরাও। লঞ্চের ক্যাশিয়ারের হাতে ২০টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে এক দৌঁড়ে লঞ্চ থেকে নেমে পড়লো রঙ্গলাল। 

ঘাটের পন্টুন পেরিয়ে যেতে যেতে বাদাম কিনে খায়। তারপর বাদাম চিবুতে চিবুতে জনসভাস্থলের দিকে এগুতে থাকে। 
রঙ্গলাল ভাবতে থাকে কিভাবে রাত কাটাবে! কোথায় থাকবে! জনসভার স্থানেও আইনশৃংখলা বাহিনীর সরব উপস্থিতি। জনসভাস্থলের অদূরে এখানে ওখানে মানুষের জটলা। 

আগামীকালের বিশাল জনসভাকে উপলক্ষ করে বসেছে বিভিন্ন দোকান। নানা রকম খাবারে পসরা সাজিয়েছে ওরা। জটলায় জটলায় গল্প করছে মানুষজন। আলোচনার বিষয় পদ্মাসেতু। আগামীকালের জনসভা! কত মানুষ হবে! কেউ বলে দশ লাখ। আর কেউ বলে বিশ লাখ! যারা পদ্মাসেতু ও আগামীকালের জনসভা নিয়ে আলোচনা করছে তাদের কথা মন দিয়ে শোনে রঙ্গলাল।

তাদের কথার ফাঁকে রঙ্গলাল তাদের প্রশ্ন করে, ভাইনজান, আমরা কাইল কি সেতু দিয়ে ওপারে যাইবার পারুম!
রঙ্গলালের কথা শুনে সবাই হেসে উঠে। একজন বলে উঠলেন, তুমি একটা পাগল। জান না এই সেতু দিয়া হাঁইটা যাওন যাইবোনা!

রঙ্গলালের হতাশার সুরে পরবর্তী প্রশ্ন, তাইলে আমি ওই পাড়ে যামু ক্যামনে!
একজন রঙ্গলালকে হাল্কা ধাক্কা দিয়া বলল, এই পাগলা যাও এহান থেইক্যা! পাগলা নাকি হাইট্টা ওই পাড়ে যাইব! 

এই কথা শুনে সবার একসাথে হাসি আর থামেনা। 
রঙ্গলাল আসলে জানেনা পদ্মাসেতু দিয়ে হেটে যাওয়া যাবেনা!
আস্তে আস্তে রাত বাড়ে। 

রাতটা্ কোথায় কাটাবে এই চিন্তা তার আর নেই। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কীভাবে সেতুতে উঠা যায়! এই আামার গর্বের পদ্মাসেতু! অহংকারের পদ্মাসেতু! এই সেতুতে আমাকে উঠতেই অইব। 

খুব জেদি রঙ্গলাল। যা বলে তা করে! এইটাই রঙ্গলালের জেদ। জনসভার স্থানসহ পুরো এলাকা আলোয় আলোকিত। রঙ্গলাল হাঁটতে হাঁটতে একটু গ্রামের দিকে এগিয়ে যায়। ছোট রাস্তা ধরে গ্রামের ভিতরে ঢুকে পড়ে। উদ্দেশ্য সেতু নিয়ে কে কি বলছে তা শোনাই তার ইচ্ছে। 

ছোট্ট চায়ের দোকানে মানুষের জটলা। টিভির সামনে বসে সংবাদ শুনছে মন দিয়ে। রঙ্গলাল চা খাওয়ার জন্য ঢুকে পড়ে দোকানে। এক কোণায় বসে চায়ের অর্ডার করে। আর সবার সাথে রঙ্গলালও খবর শোনে। 

একটা বিষয় রঙ্গলালকে অবাক করেছে। তাহলো টিভির সংবাদ এতো আগ্রহ ভরে দেখার কারণ কি?

রঙ্গলাল মানুষকে আগ্রহ নিয়ে সংবাদ শুনতে দেখেছে একাত্তুরে মুক্তিযুদ্ধের সময়। তখন ছিল রেডিওর যুগ। মুক্তিযুদ্ধের খবর নিতে তখন বাঙ্গালিরা রেডিওর সামনে জড়ো হতো। কান পেতে খবর শুনতো। আর এখন তো সেই যুদ্ধ নেই। কিন্তু আজ এতো আগ্রহ করে মানুষের খবর শোনার কী আছে ! 

পদ্মাসেতুর আগামীকাল এইখানেই তো উদ্বোধন হবে। এই সংবাদ তো সবার জানা। কিন্তু আজ মানুষ আগ্রহ ভরে খবর শোনার কারণ কি ? রাত দশটার খবর পরিবেশন করতে স্ক্রীনে সংবাদ পাঠিকার ছবি ভেসে উঠতেই টিভির সামনে উপস্থিত সবাই এক্কেবারে চুপ। 

হাস্যময়ী সংবাদপাঠিকা যখন বলে উঠলেন, কাল স্বপ্নের পদ্মাসেুতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেথ হাসিনা। সাথে সাথেই সবাই তালি দিয়ে উঠলো। উচ্চ্বাসে আনন্দে ফেটে পড়ছে উপস্থি সবাই। সাথে রঙ্গলালও। 

রঙ্গলাল চা খেয়ে আবার জনসভার স্থলের দিকে পা বাড়ায়। আশেপাশের দোকানে লোকজনের ভীড় আরো বাড়ছে। সেতু নিয়ে কথা আর শেষ হয়না। রাত গভীর হয়। রঙ্গলাল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আজ রাতটা্ এখানেই কাটাবে। পেটের ক্ষুধা নিবারণ করতে একটি ছোট্ট খাবারের দোকানে রাতের খাবার সেরে নেয়। রাত বাড়ে। রঙ্গলালের মধ্যে সেতুতে উঠার পরিকল্পনা বারবার দোল খায়। একসময় দোকানের টুলে ঘুমে নুয়ে পড়ে। এর মধ্যে সকাল হয়। তারপর জনসভার দিকে পা বাড়ায়।

ভোরে আলো ফুটতেই জনসভার স্থলে হাজার হাজার মানুষ। এতো মানুষ কোত্থেকে এলো বুঝে উঠতে পারেনা রঙ্গলাল। রাতে দু’বার জনসভার স্থলে ঘুরে গেছে। তখন কাকপক্ষিও ছিলনা। তাহলে এতো মানুষ কোত্থেকে এলো! 

মাথায় লালপট্ট্রি বাঁধা এক সত্তরোর্ধ লোকের কাছে জানতে চাইলেন রঙ্গলাল- এত্তো সকালে কইত্তন আইছেন দাদা!
ভদ্রলোক আনন্দের ছটা মুখে নিয়ে বললেন, মুই বরিশাল তে আইছি। শেখের মেয়েরে দেখবার আইছি। মুই লঞ্চে একফোটা ঘুমাই নাই। কী আনন্দ আমার! 

ভদ্র লোকের কথা শুনে রঙ্গলাল আর কিছু জানতে চায় নাই। এখন অপেক্ষার পালা। কখন প্রধানমন্ত্রী আসবেন।আর উদ্বোধন করবেন স্বপ্নের পদ্মাসেতু। 

এর মধ্যে বিমান বাহিনীর ৩১টি বিমান ও হেলিকপ্টার মনোজ্ঞ ফ্লাইং ডিসপ্লে করতে থাকে। জনসভার উপস্থিত লাখো মানুষ উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে অভূতপূর্ব এই দৃশ্য দেখে।রঙ্গলাল খুশিতে এবারও গান ধরে! আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাশে!

কিছুক্ষণের মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বাঁধভাঙ্গা আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে পুরো জনসভাস্থলে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন উদ্বোধনী ভাষণ দেন তখন পিন পতন শব্দ নেই। তাঁর আবেগঘন ভাষণে অনেকে চোখের পানি ফেলেছে। কেউ কেউ নীরব কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এমন পরিস্থিতি দেখে রঙ্গলাল নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেনি। নীরবে চোখের জল ফেলে রঙ্গলালও।

এর মধ্যে হঠাৎ জনসভায় আগত বৃদ্ধ তরুন যুবক পদ্মাসেতুর দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। সাথে রঙ্গলালও। বলতে বলতে মানুষের স্রোত পদ্মাসেতুর দিকে ধাবিত হলো। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বাঁধা সত্ত্বেও তাদের আটকানো গেলোনা। সেতুর বেশ কিছু অংশ পর্যন্ত জয় বাংলা শ্লোগান দিতে দিতে চলে গেলো উৎফুল্ল জনতা। রঙ্গলালও জয় বাংলা শ্লোগান দিতে দিতে সেতুর উপর উচ্ছ্বাসরত জনতার সাথে মিশে গেলো। ততক্ষণে জনতাকে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বুঝিয়ে সেতু থেকে নামাতে সক্ষম হলেন। সেই সাথে রঙ্গলালের ইচ্ছা পূরণ হওয়ায় জোরে জোরে গান গাইতে গাইতে সেতু থেকে নেমে আসে ‘আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!’

মিয়া মনসফ, যুগ্ম সম্পাদক, মোহাম্মদী নিউজ এজেন্সী (এমএনএ)। 
 

পাঠকের মন্তব্য