বিশ্বাস এবং বিশ্বাসীদের প্রতি সম্মান

মোঃ গোলাম সারোয়ার, গবেষক ও কলামিস্ট
এম গোলাম ছারওয়ার : আঠারো শতকের শেষ দশকে, যখন রাষ্ট্রের উপর গির্জার প্রভাব প্রবল তখন ইমানুয়েল কান্ট একটি বই লিখেন যার সহজ বাংলা ‘যুক্তির সীমার মধ্যে ধর্ম।‘
এই বই প্রকাশের পর খ্রিষ্টান ধর্মযাজকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডরিক উইলিয়ামের কাছে নালিশ জানান।
কান্ট তখন সমস্ত ইউরোপের দর্শনের সম্রাট। কিন্তু তাঁর লিখা যেহেতু চরম অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে তাই সম্রাট ফ্রেডরিকের মন্ত্রিসভা কান্টকে এক কড়া চিঠি লিখেন। তাঁকে জানানো হলো, ধর্ম নিয়ে কোন সমালোচনা চলবেনা। কান্ট ছিলেন কম কথার এবং বেশি চিন্তার মানুষ। তিনি ভাবলেন, ধর্ম সম্প্রদায়ের সাথে সংঘাতে গিয়ে জ্ঞানচর্চায় ব্যাঘাতের সম্ভাবনাকে সুযোগ দেয়া যাবেনা।
তিনি সম্রাটকে লিখলেন, আপনার একজন অনুগত নাগরিক হিসেবে ভবিষ্যতে আমি আমার কোনো বক্তৃতায় বা রচনায় ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না।
মহামতি কান্ট এরপরও দশ বছর বেঁচে ছিলেন। কিন্তু এরপর থেকে তিনি ধর্ম নিয়ে আর বিরূপ মন্তব্য করেননি কখনো। তবে তিনি বলেছিলেন, এই যে নক্ষত্রখচিত রাতের মহাকাশ, এর সৃষ্টির পেছনে নিশ্চয়ই রয়েছে মহারহস্য—কোনো এক মহাশক্তি। সেই মহাশক্তিকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন।
কুড়ি শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী যৌক্তিক ও বিজ্ঞানের বিশ্লেষণী দার্শনিক ভিটগেনস্টাইন বলেছেন, বিজ্ঞানের প্রধান রহস্যগুলোর সমাধান হয়ে যাওয়ার পরেও মানবজীবনের কিছু প্রশ্ন অজানাই থেকে যাবে।
গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটন এবং আইনস্টাইন পৃথিবীর সেরা সেরা পদার্থ বিজ্ঞানী ছিলেন। তাঁরা ধর্মের সাথে সংঘাতে না গিয়েই জগতকে বহুকিছু দিয়ে গিয়েছেন। তাঁরা মহাজগতের বস্তুর রহস্য ও সত্য উদ্ঘাটন করেছেন। যদি সংঘাতে পড়ে থাকতেন তবে তাঁরা সত্যের কাছে পৌঁছতে পারতেন না। মাঝপথে ঝরে যেতেন।
নিকোলাস কোপার্নিকাস ১৫৪৩ সালে বলেন, ‘মহাবিশ্বের কেন্দ্র বলে কিছু নেই এবং পৃথিবীর কেন্দ্র মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়।‘ তৎকালীন খ্রিস্টান ধর্মীয় বাস্তবতায় এটি ছিলো ভয়াবহ কথা। কারণ পৃথিবীই যদি মহাবিশ্বের কেন্দ্র না হয় তবে ‘মানুষ সৃষ্টির জন্য জগৎ সৃষ্টি এবং মানুষই জগতের কেন্দ্রীয় সত্ত্বা’ ধারণা বিপদে পড়ে।
কোপার্নিকাস বিজ্ঞানের সত্য প্রকাশ করেছেন কিন্তু পথেঘাটে কথাবার্তায় ধর্মকে অবজ্ঞা করতেন না। সত্য অন্বেষণ এক জিনিস আর ধর্মকে অপমান করা কিংবা মানুষের বিশ্বাসকে অপদস্ত করা আরেক জিনিস। তিনি এসব করতেন না।
সত্য ও বিজ্ঞানের জন্য জীবন সাধনা করলেও মৃত্যুর পর কোপার্নিকাসকে দর্মবার্গ ক্যাথিড্রালে কবর দেয়া হয়। ক্যাথিড্রাল মানে হলো একটি শহরের বৃহত্তম গির্জা বা খ্রিস্টানদের উপাসনালয়।
এগুলো কেন বলছি ? বলছি এ কারণে যে, আমরা একটি অস্থির সময়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সমাজের মনস্তত্ত্ব খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষের বিশ্বাসের পরিবর্তন হচ্ছে। সরকার কে ? সরকার হলো জনগণের প্রতিনিধি। নিশ্চিতভাবেই তাঁরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের মূল্য দিয়ে চলবে। তাই যারা চিন্তার কথা লিখেন তাদের মাথায় রাখতে হবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনকষ্টের কারণ হচ্ছে কিনা তাদের চিন্তা এবং মতামত।
জগতে সব বিজ্ঞানী, দার্শনিকদের ভাগ্য নিকোলাস কোপার্নিকাসের মতো ছিলোনা। ইতালিয় দার্শনিক জর্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মেরেছিলো খ্রিস্টান মৌলবাদীরা। অথচ ব্রুনো নিজেই ছিলেন একজন ধর্মযাজক, বিশ্বতত্ত্ব বিশারদ এবং গূঢ় রহস্যাদিতে বিশ্বাসী ব্যক্তি। তিনি শুধু বলেছিলেন, ‘মহাবিশ্ব অসীম এবং এর কোন কেন্দ্র নেই।‘
মহাবিশ্বের কেন্দ্রের জন্য ব্রুনোকে মেরেছিলো ব্যাপারটি এমনও না। আসলে প্রতিটি সমাজে বেশিরভাগ মানুষ সরল ধর্মবিশ্বাসী এবং নির্বিবাদী হলেও কিছু কিছু মানুষ থাকে খারাপ। তারা পরিস্থিতি ঘোলাটে করে। এই কিছু কিছু মানুষ এটি করে তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। এটি করার সুযোগ দেয়া যাবেনা। সে সাথে এটিও করা যাবেনা, কারো ধর্ম বিশ্বাসকে ক্রমাগত আঘাত।
ধর্ম অবিরামভাবে বিজ্ঞানকে বাধা দিয়ে এসেছে সুপ্রাচীনকাল থেকে এটি ঠিক নয়। এটি যদি ঠিক হতো, তবে শতকরা নিরানব্বই ভাগের বেশি ধর্মপ্রাণের পৃথিবীতে বিজ্ঞান এতদূর এগুতে পারতোনা।
আমরা সহনশীলতার কথা বলি। মানুষের বিশ্বাসকে সম্মান করার কথা বলি। সরকারকে সহায়তার কথা বলি। এসবের ভিতরে থেকেই বিজ্ঞান ও দর্শনের সেবা করতে বলি। এটি করতে ব্যর্থ হলে আপনি পৃথিবীতে বহুকিছু দিয়ে যেতে পারবেন না।
সে কারণেই আপনাকে বলতে হবে পরিশীলিত কথা। করতে হবে পরিশীলিত কাজ। রাষ্ট্রের মাঝে অযথা উস্কানীর সৃষ্টি করা যাবেনা। যারা এগুলো করে তাদের আইনের আওতায় রাখতে হবে।
আবার যারা বিনা অপরাধে মানুষকে অপমান করে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যারা ‘কেউ ধর্ম অবমাননা না করলেও কারো বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাকে গণ অসন্তোষের মুখোমুখি করে’ তাদেরও চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
পাঠকের মন্তব্য