ভিন্নতাই আপনার অবস্থান তৈরি করবে (প্রথম পর্ব)

অধ্যাপক ডাঃ মোঃ মিজানুর রহমান
ড. মীজানুর রহমান : উদ্যোক্তাদের একটি বাজার অংশকে টার্গেট করে বাজারে নামতে উপদেশ দেয়া হয়। বাজারের যে অংশটিকেই নির্দিষ্ট করা হোক না কেন সেখানে গিয়ে একটা পজিশন দখল করতে হবে। বাজারজাতকরন সাহিত্যে 'প্লেস' (place) এবং 'পজিশন' (position) সম্পূর্ণ আলাদা শব্দ। যদিও অভিধানে দুই শব্দের অর্থ প্রায় কাছাকাছি। প্লেস শব্দটি আক্ষরিক অর্থেই একটি স্থানকে বুঝায়। পণ্য যতই মানসম্মত হোক না কেন এটাকে ক্রেতাদের হাতের কাছে রাখতে হবে অর্থাৎ দোকানের শেলফে যদি নির্দিষ্ট পণ্যটি না থাকে তাহলে ক্রেতা হয়তো যেটা তার সামনে পড়বে সেটাই কিনে নেবে। বিশেষ করে নৈমিত্তিক ভোগ্য পণ্যের ক্ষেত্রে এটা হওয়াই স্বাভাবিক।
সেজন্য দোকানদারের শেলফের মধ্যে একটা জায়গা করে নিতে হবে। এমনকি দোকানের শেলফে বা তাকে পণ্যটি কোথায় রাখা হলো, উপরের দিকে, না নিচের দিকে, সেটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত দেখা গেছে চক্ষুর সমান্তরালে যে সকল পণ্য থাকে ক্রেতারা সেগুলোর প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। অতএব দোকানের শেলফে একটু জায়গা পেতেই হবে। এটাকে মূলত মার্কেটিংয়ে প্লেস' বলা হয়। যদিও এরসাথে গুদামজাতকরন, পরিবহন, সংরক্ষন, ইনভেন্টরি, ডেলিভারি ইত্যাদি কর্মগুলো জড়িত।
'পজিশন' শব্দটির অর্থ একটি স্থান বা জায়গা হলেও সেটা দোকানের শেলফের মধ্যে নয় বরং এই জায়গা হচ্ছে মানুষের মনের মধ্যে। মানুষের মনের মধ্যে জায়গা করে নেয়ার চেষ্টাকে মার্কেটিংয়ে 'পজিশনিং' বলা হয়। আমার জানা এক ভদ্রলোক গত প্রায় চল্লিশ বছর যাবত বাটার জুতা কিনে, আর অন্য কোন জুতা কিনেন না । আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি গত ৪০বছর যাবৎ টানা বাটার জুতা কিনে যাচ্ছেন এর কারণটা কি? ডিজাইন কি খুব ভালো? দামে সস্তা? তিনি বলেছিলেন, "অনেকদিন টিকে, একবার কিনলে কয়েক বছর ঝামেলা করে না"।
এই স্থায়িত্ব বা টেকসয়ত্ এটাই হচ্ছে ক্রেতার মনে বাটার পজিশন। মার্কেটিং এ দুটো কাজই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দোকানে জায়গা পাওয়া বেশ কষ্টকর। যারা নতুন কোম্পানিতে চাকরি করেন তাঁরা তা ভালোভাবেই জানেন অভিজাত দোকানে পণ্য উঠাতে গিয়ে কতটা বেগ পেতে হয়। ছোটখাটো কোম্পানিকে বড় বড় দোকানিরা একেবারে পাত্তাই দিতে চায় না।
কারণ তাদের দোকানের ভাড়া প্রতি স্কয়ার ইঞ্চি হিসাব করে পরিশোধ করতে হয়। যার কারণে তারা তাদের দোকানের জায়গা সর্বোচ্চ লাভজনক ব্যবহার করতে চায়। যার কারণে বেশিরভাগ সময়ই দোকানিরা তাকিয়ে থাকে জাতীয় ও বহুজাতিক বড় বড় কোম্পানির বিক্রয়কর্মী এবং তাদের সরবরাহ ভ্যানের দিকে। ছোট এবং নতুন কোম্পানির বিক্রয় কর্মীদের অনেক কষ্ট করে বড় দোকানে জায়গা করে নিতে হয়। কখনো কখনো কোম্পানি থেকেও তাদেরকে দোকানের নাম ধরে, যেমন- আগরা, মিনা বাজার, আলমাস, ইউনিমার্ট এই সকল দোকানে তাদের কোম্পানির পণ্য উঠানোর টার্গেট দিয়ে দেওয়া হয়।
বলা হয় এক মাসের মধ্যে অন্তত এই দুইটি অভিজাত দোকানের শেলফে কোম্পানির "রান্ধবী" গুঁড়া মসলা রাখা চাই। (প্রস্তাবিত "রান্ধবী" শব্দটি বান্ধবীর মতো শোনালেও এর কোন অর্থ নেই। বাংলা ভাষায় এ ধরনের কোনো শব্দও নেই, যেমনটি Kodak, Exxon এই শব্দগুলোরও কোন অর্থ নেই)। বিক্রয় কর্মী বহু চেষ্টা করে ডিসপ্লে ম্যানেজারের সাথে অনুনয় বিনয় করে কখনো কখনো জায়গা করে নিতে পারে কিন্তু ডিসপ্লে ম্যানেজার এর উপরে যে স্টোর ম্যানেজার থাকে সে সেটা সহজভাবে নেয় না। ধরা যাক নতুন প্রতিষ্ঠিত একটি কোম্পানি তার উৎপাদিত 'রান্ধবী' গুড়া মসলার জন্য একটি অত্যন্ত নামিদামি দোকানের শেলফে একটু জায়গা পেল। আর এই জায়গাটি যাতে অন্য কোম্পানি দখল করতে না পারে সেখানে পাথরের শেলফের মধ্যে তার কোম্পানির নাম লিখে আসলো।
"দিস প্লেস ইজ রিজার্ভড ফর রান্ধবী" গুড়া মশলা । লেখার উপরে কয়েক প্যাকেট গুড়া মশলা রেখে আসলো। তিন দিন পরে আবার সেখানে দেখতে গেল। গিয়ে দেখে তার মসলাও নাই, লেখাও নাই। কারণ ডিসপ্লে ম্যানেজার 'রান্ধবী' রাখলেও স্টোর ম্যানেজার এসে সেগুলোকে বস্তায় ভরে বেজমেন্টে পাঠিয়ে দেয়। এবং সেখানে রাঁধুনী, প্রাণ, ফ্রেশ- এ সকল ব্র্যান্ডের গুড়া মশলা রেখে দিয়েছে। পাথরে লেখা রান্ধবীর নাম মুছে ফেলেছে। যার কারণে আমি বিক্রয়কর্মীদের মান্না দে'র বিখ্যাত গানটি স্মরণ করতে বলি, "...পাথরে লেখো নাম, পাথর ক্ষয়ে যাবে; হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে"। হৃদয়ে নাম লেখার কাজটাই হচ্ছে পজিশনিং। যদি কারো হৃদয়ে দৃঢ় অবস্থান নেয়া যায় তাহলে সেই ক্রেতা দোকানে এসে শেলফের মধ্যে রান্ধবী না পেলেও বিক্রয় কর্মীদেরকে বলবে আমাকে রান্ধবী দেয়ার ব্যবস্থা করুন। দোকানদার অন্যান্য মসলা দেখালেও সে বলবে, "আমার রান্ধবীকেই চাই; প্রথমত, দ্বিতীয়ত এবং শেষ পর্যন্ত"। তখন দোকানের বিক্রয়কর্মীরা বেজমেন্টে গিয়ে রান্ধবীকে এনে ক্রেতার হাতে দিবে। অতএব হৃদয়ে স্থান পাওয়া গেলে দোকানদারের শেলফে স্থান না পেলেও চলবে। বেসমেন্টে থাকলেও পণ্য বিক্রি হবে। অর্থাৎ পজিশন থাকলে প্লেস পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক উপাচার্যকে দেখেছি উপাচার্যের পজিশন পাওয়ার পর কোন সভা সমিতিতে বিলম্বে গিয়েও বসার স্থান পেতে কোন অসুবিধা হয়নি। সামনের সারিতে স্থান(place) পেয়ে যেতেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ক্রেতার হৃদয়ে স্থান পাওয়ার উপায়টা কি ? সোজা কথা হচ্ছে ক্রেতর মনে দাগ কাটতে হবে। একটাই বুদ্ধি সেটা হচ্ছে ভিন্ন কিছু করা, যেটা আমরা গত ইস্যুতে (সংকটে মার্কেটিং-৯) আলোচনা করেছিলাম। সেখানে পন্যটা ভিন্ন রকমের হতে পারে(product differentiation)। পণ্যের রং, ডিজাইন, গুণাবলী, আকৃতি, মান ইত্যাদি প্রতিযোগীদের থেকে আলাদা হবে। দ্বিতীয় পৃথকীকরণের হাতিয়ারটি হচ্ছে সেবা(service differentiation)। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পণ্যে ভিন্নতা আনা ব্যয়বহুল এবং কঠিন কাজ। ধরা যাক, একজন উদ্যোক্তা ঢাকা- কক্সবাজার এর মধ্যে একটা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস সার্ভিস চালু করতে চাচ্ছে।
এক্ষেত্রে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসের মধ্যে ভিন্নতা আনা মোটেই সম্ভব না। কারণ ঢাকা কক্সবাজার রুটে যে এয়ারকন্ডিশনড বাসগুলো চলাচল করে এগুলো 'হিনো' অথবা 'ভলভো' কোম্পানির তৈরি। কোন বাস পরিচালনা কোম্পানি গাড়ি তৈরি করে না। অতএব গাড়িতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা কোনভাবেই বাস কোম্পানির পক্ষে সম্ভব নয়। হয়তো ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন অথবা বাহ্যিক রঙে কিছু পরিবর্তন আনা যেতে পারে, যা এয়ারকন্ডিশনড বাসে ভ্রমণকারীদের নিকট ততটা গুরুত্ব পাবে না। তাছাড়া সবার জন্য ঢাকা- কক্সবাজার এর রাস্তার দূরত্ব সমান এবং একই রাস্তায় যেতে হয়। তখনই সেবার ব্যাপারটি চলে আসবে। যেমন কোন একটা বাস কোম্পানি তাদের পুরো টিকেট পদ্ধতিটা অনলাইন করতে পারে , যাতে টিকিট কেনার জন্য যাত্রীদের কাউন্টারে আসতে না হয় অথবা যাত্রীদেরকে অতিরিক্ত বিনোদনের জন্য গাড়িতে পৃথক পৃথক মিউজিক শোনার এবং সিনেমা দেখার ব্যবস্থা করে দিতে পারে, যেটা উড়োজাহাজে করা হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে নতুন যে সেবাই বাস সার্ভিসের সাথে সংযুক্ত করা হবে প্রতিযোগী কোম্পানীগুলো একই সেবা যুক্ত করে পৃথকীকরণের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিবে।
পৃথকীকরণের তৃতীয় উপায়টি হচ্ছে বন্টন প্রণালীতে নতুনত্ব নিয়ে আসা (channel differentiation)। যেমন ঢাকা শহরে অনেককেই প্রতিদিন বাসি পাউরুটি খেতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাউরুটিগুলো আগের দিন তৈরি করা হয়, যেগুলো আমরা পরের দিন সকালে নাস্তা হিসেবে খাই। এই ব্যাপারে পৃথকীকরণ করা যেতে পারে । কোন একটি কোম্পানি ঘোষণা করতে পারে আমরা ভোররাত্রে পাউরুটি বানাই এবং প্যাকেট করি, ভোর পাঁচটার মধ্যে পাউরুটি হকারদের হাতে চলে যায় এবং সকাল সাতটার মধ্যে প্রত্যেকের বাসায় বাসায় গরম পাউরুটি পৌঁছানো হয়। দৈনিক পত্রিকা ভোর বেলায় প্রত্যেকের বাসায় পৌঁছানো গেলে পাউরুটি পৌঁছে দিতে অসুবিধা কোথায় ?
চতুর্থ পৃথকীকরণের হাতিয়ারটি হচ্ছে ব্যক্তিক পৃথকীকরণ (personnel differentiation)। যেমন একটি বাস কোম্পানি ঘোষণা করতে পারে অন্যান্য বাসে যারা আপনার সহযোগিতার জন্য থাকবে তারা হচ্ছে বাসের 'হেলপার', আর আমাদের বাসে যারা আপনাদের সঙ্গ দেবে তারা "কাস্টমার কেয়ার ম্যানেজার", এমবিএ ডিগ্রিধারী। তাঁরা অত্যন্ত প্রোএকটিভ হবে। বাংলাদেশ বিমান আর সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স এর মধ্যে উড়োজাহাজের বিবেচনায় আমাদের নতুন "ড্রিমলাইনার" উড়োজাহাজগুলো সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজের চেয়ে উন্নত, কিন্তু সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ব্যক্তিক(personnel) সেবা অতুলনীয়। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের সার্ভিস প্রদানকারীরা অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা যাত্রীদের সেবায় হয় প্রোএকটিভ। আর আমাদের বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের লোকদের ডেকেও কাছে পাওয়া যায় না। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসার সময় যাত্রীদের (যাদের উপার্জনের টাকায় বছরের পর বছর লোকসানী সংস্থা বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন দেয়া হয়) সাথে যে ধরনের অসম্মানজনক ব্যবহার করে তা আমি নিজেই একবার দুবাই থেকে আসার সময় প্রত্যক্ষ করেছি।
পৃথকীকরণের সর্বশেষ উপায়টি হচ্ছে ইমেজ তৈরি করা(image differentiation)। কোম্পানির ইমেজ ভালো হলে সেটা গিয়ে পণ্যের ইমেজের ওপর পড়ে। বাজারে অনেক কোম্পানি আছে যারা দীর্ঘদিন যাবত সুনামের সাথে ব্যবসা করে ইমেজ তৈরি করেছে। নতুন কোম্পানির পক্ষে রাতারাতি ঐ ধরনের ইমেজ তৈরি করা কঠিন কাজ। সেজন্য তাদেরকে বিভিন্ন গণসংযোগ, প্রচারণা এবং সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কোম্পানির অনুকূল ইমেজ তৈরি করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে কমিউনিটি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কোম্পানিকে একটি ভালো কর্পোরেট সিটিজেনের ভাবমূর্তি তৈরি করতে হবে। তাহলেই কেবল প্রতিষ্ঠিত পুরনো ঐতিহ্যবাহী কোম্পানিগুলোর সাথে পৃথক একটি অবস্থান নেয়া যাবে।
অবস্থান গ্রহণের সবচেয়ে ভালো সুপারিশ করেছেন- Al Ries এবং Jack Trout । তাঁরা তিনটি কৌশলের কথা সুপারিশ করেছেন। এর প্রথমটি হচ্ছে কোম্পানির মূল শক্তিটিকে মানুষের সামনে উদ্ভাসিত করা এবং সেটাকেই আরও শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে মানুষের মনে জায়গা করে নেয়া। গাড়ি ভাড়ার জগতের রানারআপ কোম্পানি Avis যেমনটি করেছিল।
তারা বলেছিল, We are only number #2, so we try harder । কোম্পানিটি বিশ্ববাজারে তাদের দ্বিতীয় অবস্থানটাকে তাদের শক্তি হিসেবে ক্রেতাদের সামনে তুলে ধরে। যেহেতু তাদের অবস্থান দ্বিতীয় অতএব তারা কঠোর পরিশ্রম করছে প্রথম হওয়ার জন্য; এমন একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত এর মধ্যে আছে। ধরা যাক, একজন পাউরুটি বিক্রেতা ঢাকার বনশ্রী এলাকায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। এই পাউরুটি বিক্রেতার প্রথম কাজ হচ্ছে কেন বনশ্রী এলাকার মানুষ তাঁর কনফেকশনারীর পাউরুটি পছন্দ করে তা অনুসন্ধান করে জেনে নেয়া। সে জেনেও গেল, তাঁর পাউরুটি অনেক 'সফট', তাই এলাকার মধ্যে তাঁর অবস্থান প্রথম। অতএব এই পাউরুটি বিক্রেতার কাজ হবে সম্ভব হলে পাউরুটি আরো সফট করা এবং এই পাউরুটির সফটনেসের ব্যাপারটি জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা।
সুন্দরী প্রতিযোগিতায় যে প্রথম হবে (বাংলাদেশ তোমাকে খুঁজছে !) তাঁর কাজ হচ্ছে কেন দর্শকরা তাঁকে এসএমএস এর মাধ্যমে এত বেশি ভোট দিল তা জানার চেষ্টা করা। সে জেনেও গেল; তাঁর চুলগুলো অনেক লম্বা ও সুন্দর এই জন্য তাঁকে সবাই বেশি ভোট দিয়েছে। অতঃপর এই সুন্দরীর কাজ হচ্ছে তার চুল আরও লম্বা করা এবং বিভিন্নভাবে চুল প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। সে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রী হয় তাকে চেষ্টা চালাতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সপ্তাহে 'ফ্যাশন শো' এর সাথে একটি 'লম্বা চুলের প্রতিযোগিতার' আয়োজন করার জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা।
দ্বিতীয় কৌশলটি হচ্ছে একটি খালি জায়গা দখল করা। বিক্রেতাকে জরিপ করে বের করতে হবে ভোক্তারা কিনতে চাচ্ছে কিন্তু পাচ্ছে না , সেরকম একটি খালি জায়গা বা গ্যাপ পাওয়া গেলে সেখানে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নেয়া। ভিড়ের মধ্যে না গিয়ে আলাদা থাকা গেলে সহজে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়।
ইদানিংকালে বিয়ে বাড়িতে সহজে কনের উপস্থিতি দেখা যায় না। কোথাও কোথাও বিয়ের খাওয়া দাওয়া শেষ হলেও কনে এসে পৌঁছতে পারেনা। কারণ কনে বিউটি পার্লারে আটকা পড়েছে। পার্লারে লম্বা সিরিয়াল থাকায় কনের সাজগোজ বিলম্বিত হচ্ছে। এছাড়া কনের সাথে সাথে তার খালাতো বোন, মামাতো বোন, বিশ্ববিদ্যালয় বান্ধবীরাও মাইক্রো বাস করে সাজতে যায়। যারা সাজতে যায় তাদেরকে বিউটি পার্লারে যাওয়ার অন্তত একদিন আগ থেকেই প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়। কচি ডাবের পানি দিয়ে মুখ ধোয়া, দুধের সর মাখা, শসা কেটে চোখের উপর রেখে দেওয়া, কাঁচা হলুদ বাটা লাগানো ইত্যাদি কাজ বাড়িতেই করতে হয়।
কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় এত কষ্ট করে সেজেও অনেকেই কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে না। কারণ এদের অনেকে কনের জন্য নির্ধারিত মঞ্চে গিয়ে অবস্থান নেয়। সে বুঝতে পারে না আজকে সবাই কনেকেই দেখছে। তাছাড়া অনেক দামি শাড়ি ও গহনা পরায় কনেকে অন্যদের চেয়ে আকর্ষনীয় দেখানোই স্বাভাবিক। সেজন্য আমার সাজেশন হচ্ছে বিয়ে বাড়িতে গিয়ে কনের মঞ্চ অথবা সুন্দরীদের ভিড়ের মধ্যে না যাওয়া। পারলে সম্পূন্ন একটি খালি জায়গায় বসে থাকা অথবা দোতালায় চলে যাওয়া, যেখানে কেবল মাত্র ছেলেদের খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তখন দেখা যাবে পুরো ফ্লোরে একজন মহিলা, আর সবাই তার দিকে তাকাচ্ছে। দুইদিন যাবত কষ্ট করে সাজাটা কাজে লাগলো।
তৃতীয় কৌশলটি হচ্ছে বর্তমান অবস্থান ভেঙে বেরিয়ে নতুন অবস্থান নেয়া। প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে মানুষের ধারণা সঠিক থাকে না। যেমন আমার ধারণা ছিল ডায়মন্ডের দোকানে কয়েক লক্ষ টাকা ছাড়া ঢুকে কোন লাভ নেই। আমি কখনো ডায়মন্ডের দোকানে ঢুকতে সাহস পাই নাই। কিন্তু আমার এক শিক্ষার্থী আমার ভুল ভেঙে দেয়, সে আমাকে জানায় ডায়মন্ডের দোকানে ৫ হাজার টাকা দিয়েও কিছু একটা পাওয়া যায় (নাকফুল জাতীয়)। একই ধারণা হোটেল সোনারগাঁয়ের খাবার সম্পর্কে। বেশিরভাগ লোকেরই হোটেল সোনারগাঁয়ে ঢোকার অভিজ্ঞতা নেই। মিনিবাসে এয়ারপোর্টে আসা যাওয়ার সময় জানালা দিয়ে হোটেল সোনারগাঁ দেখেই ধারণা করে বসে আছে এই হোটেলের খাবার অনেক ব্যয়বহুল হবে। কিন্তু আসলে কি তাই? ঢাকা শহরে আরো অনেকগুণ বেশি ব্যয়বহুল খাবারের দোকান আছে। মানুষের ভুল ধারণা সোনারগাঁও হোটেলে খেতে অনেক টাকা লাগে। এই ভুলটা ভেঙে দেয়ার দায়িত্ব হোটেল কর্তৃপক্ষের।
এই সব কিছুই করা হবে ক্রেতার মনে একটু অবস্থান নেয়ার জন্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ক্রেতার মন কি খালি আছে? আর খালি থাকলেও সেটা কত নম্বর অবস্থান। আজকাল শুনেছি ক্লাস ফোর ফাইভের ছেলে-মেয়েরাও নাকি জিজ্ঞেস করে নেয়, "এই ! তুমি কি এংগেজড?" একেবারে খালি মন পাওয়া সম্ভাবনা নেই। পেলেও প্রথমদিকের স্থান পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। প্রথমদিকে স্থান না পেলে তৃতীয়, চতুর্থ ইত্যাদি স্থানের আসলে কোন গুরুত্ব নেই। মানুষ প্রথম জনকেই মনে রাখে। এভারেস্টে(২৯,০৫৩ ফুট) প্রথম উঠেছিল হিলারি এবং তেনজিং(Sir Edmond Hilary and Tenzing Norgay- ২৯ মে, ১৯৫৩)।
এরপরে কত লোক এভারেস্ট জয় করেছে। খুব কম লোকই বলতে পারবে কে বা কারা দ্বিতীয় তৃতীয় হয়েছিল। বিক্রমপুরের ব্রজেন দাস (১৯২৭-১৯৯৮) প্রথম এশিয়ান, যিনি ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিল । এরপরে বহু এশিয়ান এমনকি ভারতীয় সাঁতারু ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছে এদের মধ্যে দ্বিতীয় জন কে ছিল কেউ বলতে পারবে না। অতএব মনের জায়গাটা প্রথমদিকে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু সেই জায়গা তো বহু আগেই দখল হয়ে আছে। একেবারে মইয়ের মত, প্রত্যেক পণ্যের একটা মই আছে তাতে প্রথম -দ্বিতীয়- তৃতীয় ইত্যাদি অবস্থানগুলো সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে আছে ঐতিহ্যবাহী কোম্পানিগুলো।
একবার যদি কেউ নেতৃত্বে চলে যায় সহজে আর কাউকে ছাড় দেয় না। অনেকটা আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার হওয়ার মতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে কোম্পানিগুলো বাজারে প্রথম- দ্বিতীয়- তৃতীয় এগুলো বিশ- ত্রিশ -পঞ্চাশ বছর যাবত তাদের অবস্থান ধরে রাখে। যদিও Ries এবং Trout প্রথমে কেবল মাত্র তিনটি কৌশলের কথা বলেছিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা চতুর্থ আরেকটি কৌশল এর কথা বলেছেন। যাদের পক্ষে প্রতিযোগিতায় প্রথম-দ্বিতীয়- তৃতীয় হওয়ার সম্ভাবনাই নাই। তখন তারা ঘোষণা করে দেশের প্রথম শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি বড় কোম্পানির মধ্যে আমরা অন্যতম। এটার নাম দিয়েছে "এক্সক্লুসিভ ক্লাব স্ট্র্যাটিজি" ।
পৃথকীকরণ একটি ব্যয়বহুল এবং জটিল কাজ। অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে ভিন্ন কিছু করার জন্য। পৃথকীকরণের কারণে সৃষ্ট সুবিধা বেশি দিন স্থায়িত্ব পায়না। কারণ যেভাবেই পৃথকীকরণ করা হোক না কেন প্রতিযোগী কোম্পানিগুলো সেটা দ্রুত অভিযোজন করে নিবে। ধরা যাক, একটি কোম্পানি খুবই ভাগ্যবান এবং সে অনেকগুলো সম্ভাব্য প্রতিযোগিতামূলক পৃথকীকরণ সুবিধা শনাক্ত করল। তখন সমস্যা দেখা দেয় কয়টি পার্থক্য এবং কোন্ কোন্ পার্থক্য প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা অর্জনের জন্য ব্যবহার করা হবে। এ ব্যাপারে কোম্পানিকে অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেউ যদি মনে করে যতভাবে ভিন্নতা আনা যায় সবকটাই প্রমোট করা হবে, সেটা একটা বোকামি হবে। প্রত্যেক কোম্পানির উচিত তাদের ব্র্যান্ডের জন্য একটি স্বতন্ত্র বিক্রয় প্রতিজ্ঞা (Unique Selling Proposition-USP) উন্নয়ন করা এবং তাতে দৃঢ় থাকা। প্রত্যেক ব্র্যান্ডের মধ্যে একটা বিশেষ গুণ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যা এক নম্বর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। প্রমোট করা যায় এমন এক নম্বর অবস্থানগুলো হচ্ছে- "সর্বোত্তম মান" "সর্বোত্তম সেবা" "সর্বনিম্ন মূল্য" "সর্বোৎকৃষ্ট ভ্যালু" "সর্বোচ্চ প্রযুক্তি" "সর্বোচ্চ নিরাপত্তা" "সবচেয়ে টেকসই" ইত্যাদি।
আজকের দিনে যখন বৃহৎ বাজার ভেঙ্গে ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের অবস্থান পরিসর বৃহত্তর করার চেষ্টা করছে, যাতে তা একাধিক বিভাগের জন্য আবেদনময়ী হয়। উদাহরণস্বরূপ Beecham এবং Aquafresh টুথপেষ্টের তিনটি সুবিধার কথা প্রমোট করে। "দাঁতের ক্ষয়রোধ" "আরো ভালো নিঃশ্বাস" এবং "আরো সাদা দাঁত"। স্পষ্টতই অনেকেই তিনটি গুণেই পেতে চায় । এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একটি টুথপেস্টে তিনটি গুণেই আছে সে ব্যাপারটি ক্রেতাদের মানানো। Beecham এর সমাধান করেছে এমন একটি পেস্ট তৈরি করে যার টিউব থেকে একসঙ্গে তিন রঙের টুথপেস্ট বের হয়। যা তিনটি গুণের নিশ্চয়তা দিচ্ছে। এটা করার মাধ্যমে Beecham একটির বদলে চারটি ( তিন গুণের জন্য তিনটি, আর সব গুনের জন্য একটি) বিভাগকে আকৃষ্ট করতে পারছে। (বাকি অংশ- দ্বিতীয় পর্বে)
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠকের মন্তব্য