ভিন্নতাই আপনার অবস্থান তৈরি করবে (দ্বিতীয় পর্ব)

ড. মীজানুর রহমান
ড. মীজানুর রহমান : ... পজিশন নেয়ার সময় কোম্পানিকে চারটি ভুল পরিহার করে ঞঞচলতে হবে। প্রথমটি হচ্ছে আন্ডার পজিশনিং (under positioning) অর্থাৎ কোন অবস্থান তৈরি না হওয়ার ঝুঁকি। চা বিক্রেতা কোম্পানি একটি বিজ্ঞাপন প্রচার করলো যাতে চা বাগানের মনোরম দৃশ্যাবলির সাথে সাথে নাচে গানে ভরে দেওয়া হল এবং সবশেষে বলা হলো, "আমাদের চা পাহাড়ি চা, পাহাড়ি চা পান করুন"। এই ধরনের অবস্থান থেকে কোন ফল পাওয়া যাবে না। কারণ কিছুদিনের মধ্যেই মানুষ বুঝে যাবে, "সব চা'ই পাহাড়ে জন্মায়। এটা আর ভিন্ন কী হল"। দ্বিতীয় ভুলটি হচ্ছে পণ্যের এমন একটি অবস্থান তৈরি হওয়া যেখানে পণ্যটির ধারণা একেবারে সীমিত হয়ে পড়ে। যেমনটি হয়েছিল সোনারগাঁ হোটেলের খাবারের ব্যাপারে। এটাকে বলা হয় ওভার পজিশনিং (over positioning), এতে কোম্পানির সম্পর্কে তাদের ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়।
আরেকটা ভুল হচ্ছে দ্বান্দ্বিক অবস্থান (confused positioning)। একেক সময় একেক ধরনের দাবি করা। ছাতু জাতীয় কিছু একটা বাজারে ছেড়ে কিছুদিন বলা হলো এটা শিশুদের খাবার, তারপরে বলা হলো এটা মায়েদের খাবার, তারপরে বলা হলো এটা মেয়েদের খাবার। এক পর্যায়ে মানুষ ভাববে, এটা আসলে কার খাবার? ইদানিংকালে কিছু অল্পবয়সী ছেলেকে দেখা যায় কয়েকদিন পর পর তাদের দাড়ি-গোঁফ এবং চুলের স্টাইল পরিবর্তন করতে। কয়েক দিন পুরো মুখে দাড়ি রাখে, পরের মাসে আবার ফ্রেন্স কাটিং করে, দুই তিন মাস অন্তর অন্তর সেলুনে গিয়ে চুলের স্টাইল পরিবর্তন করে, যার কারণে অনেক পরিচিত লোকজনও কনফিউশনে পড়ে যায়। এটা কি "সে"? বাজারে গিয়ে এক ভদ্রলোককে দেখে একজন প্রশ্ন করে বসলেন গত সপ্তাহে যার জানাজা পড়ে আসলাম উনি কি আপনি? না আপনার ভাই? চেহারার সাদৃশ্য দেখে প্রশ্নকর্তা ভদ্রলোক এত বেশি কনফিউজড হয়, তার মাথায় আসেনি যে লোকটার জানাজা পড়ে আসলাম সেই লোকটা আজকে বাজারে আসলো কিভাবে ?
সবশেষ, পজিশনিং এর ক্ষেত্রে যে ব্যাপারে সাবধান হতে হবে সেটা হচ্ছে- সন্দেহজনক অবস্থান (doubtful positioning)। কোম্পানির শক্তি এবং সামর্থের বাইরে গিয়ে কোন কিছু দাবী করলে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হয়না। যেমন- "শতভাগ গ্যারান্টি" "বিফলে মূল্য ফেরত" "পৃথিবীর সেরা" "আপনার সকল সমস্যার সমাধান" ইত্যাদি বক্তব্য মানুষের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর বিভিন্ন গালভরা বুলি প্রচার করে কিন্তু সে অনুযায়ী কাজ না করায় জনগণ তা বিশ্বাস করে না এবং ঐ সকল প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় প্রসার লাভ করে না।
পণ্য বা সেবার সকল পার্থক্য অর্থপূর্ণ নয় বা মূল্যবানও নয়। প্রত্যেক পার্থক্য দ্বারা পৃথকীকরণ করা যায় না। প্রত্যেক পার্থক্যের জন্য কোম্পানিকে টাকা খরচ করতে হয়, কিন্তু সকল পার্থক্য থেকে কোম্পানি সুবিধা পায় না। একটি পার্থক্য কতটুকু অর্থপূর্ণ এবং মূল্যবান হবে তা অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন পার্থক্যটি ক্রেতাদের নিকট কতটা গুরুত্বপূর্ণ (important)। বাজারে প্রায় সব প্যারাসিটামলই গোলাকৃতির। কেউ যদি ক্যাপসুল আকৃতির প্যারাসিটামল বানায় সেটা কোন কোন ক্রেতার খেতে সুবিধা হতে পারে। অতএব এর তাৎপর্য আছে। কিন্তু যেহেতু বাজারের সকল প্যারাসিটামল সাদা রঙের, ভিন্নতা আনার জন্য প্যারাসিটামলকে নীল রঙের করা হলো। এই পার্থক্যটি তাৎপর্যহীন কারণ প্যারাসিটামল সাদা বা নীল রঙের হওয়ার সাথে জ্বর কমার বা ব্যথা কমার কোনো সম্পর্ক নাই।
পার্থক্যটি অবশ্যই স্বতন্ত্র্য (distinctive) হতে হবে যা সুস্পষ্টভাবে ক্রেতারা অনুধাবন করতে পারে। এই প্রবন্ধের পাঠক অনেক পছন্দ করে, অনেক ঘোরাঘুরি করে একটি জামা কিনলেন। জামাটি এত সুন্দর যে তিনি অস্থির হয়ে গেলেন আগামীকাল সকালে কখন অফিসে যাবেন। জামাটি দেখে সবাই তাকে বাহবা দিবে। রাতে কয়েকবার ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে জামাটি পরে মহড়াও দিলেন। উত্তেজনায় ঘুমাতে পারলেন না। নতুন জামাটি পরে পরদিন অফিসে গেলেন, সারাদিন অফিস করলেন, মিটিং করলেন, অনেকের সাথেই দেখা হল কিন্তু জামাটি সম্পর্কে কেউ কোন কথাই বলল না। তার মানে হচ্ছে এই জামাটি একটা অডিনারি জামা। এর কোন স্বাতন্ত্র্য নেই। ভিন্নতাটি আগের চেয়ে অধিক সুবিধা দিতে হবে অর্থাৎ ভিন্নতাটি উন্নততর(superior)হতে হবে। ভিন্নতা আনতে গিয়ে আগের চেয়ে মান খারাপ হলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। কেউ একজন রান্নায় ভিন্নতা আনার জন্য মাংসের সাথে কিছু ছোট মাছ, মধু এবং করোলা মিশিয়ে দিল। এতে ভিন্নতা আসবে কিন্তু এই খাবারটি আগের কোন খাবারের চেয়ে উন্নত হবে না।
পার্থক্যটি অবশ্যই যোগাযোগের উপযুক্ত(communicable) এবং চাক্ষুষ হতে হবে। একজন পানি বিক্রেতা তার পানির উপরে লিখল "হালাল পানি" এবং দাবি করলো এর সাথে জমজমের পানি মেশানো হয়েছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিবে যেহেতু পানির মধ্যে কোন রং বা গন্ধ ব্যবহার করা যাবে না তাই হালাল এর ব্যাপারটা পুরোটাই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করতে হবে। বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে বিনা পয়সায় পেলে সব রোগের ওষুধ হিসাবে জমজমের পানি খেলেও প্রতি বোতলের জন্য ২৫ টাকা দিয়ে কেবলমাত্র বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে কয়জন জমজমের পানি খাবে সেটা সন্দেহ আছে।
পার্থক্য যাতে প্রতিযোগিরা সহজে নকল করতে না পারে (preemptive) সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। আপনার অফিসের একজন অন্যদের থেকে আলাদা হওয়ার জন্য বঙ্গবাজার থেকে চারিদিকে বোতাম লাগানো ১০০ বোতাম যুক্ত একটি তালি দেওয়া শার্ট পড়ে আসলো। সে হয়তো এক দিনের জন্য অন্যদের থেকে আলাদা থাকবে। কিন্তু দুই দিনের মধ্যেই অফিসের অনেকেই এই জামা কিনে নিয়ে আসবে। কারণ বঙ্গবাজারে মাত্র ২০০ টাকায় এ ধরনের বোতাম যুক্ত তালি দেওয়া জামা পাওয়া যায়, এটা সবাই জানে। তবে কেউ যদি অফিসে এসে দাবি করে, "আমি উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখেছি"। এটা নিশ্চিত করে বলা যায় কয়েক মাসের বা বছরের মধ্যে অফিসের আর কারও পক্ষে উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখা সম্ভব নয়। অতএব এই পার্থক্যটি অনেকদিন টিকে থাকবে।
পার্থক্য তৈরীর সময় অবশ্যই খরচের বিষয়টি মনে রাখতে হবে। পার্থক্যটির ব্যয় ভার যেন ক্রেতাদের বহনযোগ্য হয় (affordable)। অন্যান্য হোটেলের তুলনায় ভিন্নতা আনার জন্য সদরঘাট এলাকায় একটি হোটেল ঘোষণা করলো, "আমাদের হোটেলের কমোড, বেসিন সবকিছু সোনার তৈরি"। এতে দূর থেকে হোটেলটি দেখার আগ্রহ সৃষ্টি হলেও ব্যয় বহনের কথা বিবেচনা করে কেউ এই হোটেলে ঢুকবে না। সব শেষ হচ্ছে পার্থক্যটি যেন ক্রেতাদের নিকট গ্রহণযোগ্যতা পায় এবং সে অনুযায়ী ক্রেতারা সাড়া দেয় এবং সবশেষে কম্পানি যেন লাভবান হয়(profitable)।
(আমাদের কুমিল্লায় শহরের পূর্ব প্রান্তে 'রূপালী সিনেমা' নামে একটি সিনেমা হল ছিল। হলটি আমার স্মৃতি বিজড়িত এই জন্য যে এখানেই জীবনের প্রথম সিনেমা দেখেছিলাম, "সুয়োরানী- দুয়োরানী"। আমাদের আমলে সিনেমার নাম এমনটিই ছিল- "বেহুলা সুন্দরী" "রাজা সন্ন্যাসী" "কুচ বরণ কন্যা" "সাত ভাই চম্পা" ইত্যাদি। এখনকার মতো "ধর শালারে !" "পালাবি কোথায় ?" "স্বামী কেন পলাতক ?" "বাবা কেন আসামি ?" এ ধরনের সিনেমা নামকরণ তখন প্রচলিত ছিল না। সেই রূপালী সিনেমা হলটি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মালিক সিদ্ধান্ত নিল সংস্কার করবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলো পুরনো এই হলটিতে ওয়াশ রুমের দুরাবস্থা। ওয়াশরুমে সব সময় এক ইঞ্চি পানি আটকে থাকতো। মালিক প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিল ওয়াশরুমটি আধুনিকায়ন করবেন। প্রথমে ওয়াশরুমটিকে দুই ভাগে ভাগ করা হলো।
অত্যাধুনিক টাইলস ও ফিটিংস দিয়ে সুসজ্জিত করা হলো। পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য দুটি পৃথক দরজা করা হলো এবং দুটি দরজার একটিতে 'পুরুষ'এবং অপরটিতে 'মহিলা' পিতলের উপর লিখে দেওয়া হল। সম্পূর্ণ পৃথক দুটি ওয়াশরুম, একটি পুরুষদের জন্য, অপরটি মহিলাদের জন্য। এই কাজের জন্য হল মালিক বিরাট অংকের টাকা ব্যয় করলেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অনেকেইতো পড়তে জানে না। পুরুষের ওয়াশরুমে মহিলারা আর মহিলাদের ওয়াশরুমে পুরুষরা ঢুকে যাচ্ছিল। সিনেমা হলের মালিক তখন "চিত্রালী" পত্রিকা থেকে দুটি ছবি, একটি রাজ্জাকের আর একটি কবরীর, কেটে দুই দরজায় লাগিয়ে দিলেন। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না।
কুমিল্লায় এমন কিছু বেয়াক্কেল পাওয়া গেল যারা রাজ্জাক-কবরীর পার্থক্য বোঝে না। রাজ্জাকের জায়গায় কবরী ঢুকছে আর কবরীর জায়গায় রাজ্জাক ঢুকছে। এই যদি হয় অবস্থা অর্থাৎ যাদের জন্য পৃথকীকরণ করা হলো তারা যদি এর তাৎপর্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয় তাহলে এ ধরনের পৃথকীকরণ না করাই ভালো। ওয়াশ রুমের দরজা একটাই থাকবে, এতে খরচ কমে যাবে, আর যার যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঢুকুক।)
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠকের মন্তব্য