বিতর্কিত ও বহিস্কৃত ছাত্রদের নিয়ে জাবি ছাত্রলীগের কমিটি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষনা করা হয় গত ২৯ নভেম্বর। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের নাম প্রকাশের দীর্ঘ ১১ মাস পর গত ২৯ নভেম্বর (মঙ্গলবার) কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা পোস্ট করা হয়। চার বার সংশোধনের পর কমিটিতে পদপ্রাপ্তের সংখ্যা ৩৮৮ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪০৫ এ। অছাত্র, বিতর্কিত ও বহিস্কৃত অনেকেই পদ পাওয়ায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘিরে জন্ম নিয়েছে নানা বিতর্ক।
কমিটির পদপ্রাপ্ত সদস্যদের মধ্যে অনেকের নামেই বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা সময়ে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় এবং অপকর্মের দায়ে বিভিন্ন সময়ে বহিষ্কৃত হয়েছেন অনেকেই। র্যাগিং, ছাত্রদের মারধরসহ বিভিন্ন কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নানা মেয়াদে বহিষ্কৃত এবং শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনায় বিতর্কিত অন্তত ২০ জন এই কমিটিতে পদপ্রাপ্ত হয়েছেন।
চলতি বছরের ৫ আগস্ট মীর মোশাররফ হোসেন হল ও মওলানা ভাসানী হলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন ও মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় অভিযুক্ত ৪৫তম ব্যাচের সজিব হাসান সাজ পেয়েছেন উপ কর্মসূচি ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক।
২০১৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে লাঞ্ছনা ও কর্তব্যরত এক সংবাদকর্মীকে মারধরের ঘটনায় সাময়িক বহিষ্কৃত বাংলা বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শুভাশীষ ঘোষ পেয়েছেন উপ-ধর্ম বিষয়ক সম্পাদকের পদ।
২০১৯ সালের ৩০ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মচারীর জামাতাকে মারধর করে ছিনতাই ও তুলে নিয়ে মুক্তিপণ দাবির অভিযোগে বহিষ্কৃত সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫ তম ব্যাচের আল-রাজি সরকার পেয়েছেন উপ-ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদকের পদ এবং কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫ তম ব্যাচের শাহ মোস্তাক আহমেদ সৈকত হয়েছেন সহ-সভাপতি।
২০১৯ সালের ৩রা জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মিষ্টি খাওয়াকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও মওলানা ভাসানী হলের মধ্যের সংঘর্ষের মূল অভিযুক্ত ৪৫ তম ব্যাচের সৌরভ কাপালি পেয়েছেন উপ-পাঠাগার বিষয়ক সম্পাদক।
২০১৯ সালের ২২ জুলাই রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের র্যাগ দেওয়ার ঘটনায় ১১ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়। তাদের মধ্যে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ফয়জুল ইসলাম নীরব পেয়েছেন উপ-ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদকের পদ এবং ইতিহাস বিভাগের সারোয়ার হোসেন সাকিল হয়েছেন উপ-কৃষি বিষয়ক সম্পাদক।
২০১৯ সালের ১৮ই ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্য-কালীন কোর্সের এক শিক্ষার্থীর গাড়ি ভাঙ্গচুরের অভিযোগ ওঠা আসিফ রহমান খান পেয়েছেন সহ-সম্পাদক।
চলতি বছরের ২রা আগস্ট বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের অতিথিকক্ষে এক সাংবাদিক নির্যাতনের দায়ে বহিষ্কৃত আইন ও বিচার বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের মাসুম বিল্লাহ হয়েছেন সহ-সম্পাদক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস সূত্রে জানা যায় ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠা ৪৬তম ব্যাচের শান্ত মাহবুব ও অরবিন্দ ভোমিক পেয়েছেন যথাক্রমে ত্রাণ ও দূর্যোগ বিষয়ক সম্পাদক ও উপ-ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক।
এছাড়া গত ৬ আগস্ট মওলানা ভাসানী হল ছাত্রলীগের এক কর্মীকে মারধরের ঘটনায় সাময়িক বহিষ্কৃত খালিদ হাসান ও সাব্বির হোসেন সদস্য পদ পেয়েছেন।
এরপরে বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী এলাকার একটি ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ভাঙচুর ও মালামাল লুটপাটে অভিযুক্তদের মধ্যে সহ-সভাপতি হয়েছেন সাজ্জাদুল ইসলাম ও এহসানুল হক, আর সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পেয়েছেন ফারসাদ হোসেন এবং মেহেদী জয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর একটি ভ্রমণবিষয়ক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সাড়ে পঁচানব্বই হাজার টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সহ-সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন এবং কর্মী সৈয়দ লায়েব আলীর বিরুদ্ধে। হাবিবুর রহমান লিটন বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক আর সৈয়দ লায়েব আলী পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহ-সভাপতির পদ পেয়েছেন।
এর বাইরেও শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত নন এমন অনেকেই পদ পেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে খোদ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেকেই।
ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত কর্মীরা বলছেন, কিছু নেতাকর্মী জেলা ও উপজেলায় পদে থাকার পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ এ কমিটিতে পদ পেয়েছেন। যাদের মধ্যে ঢাকা জেলা উত্তরের সহসভাপতি শান্ত মাহবুবকে দেওয়া হয়েছে ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক সম্পাদকের পদ। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা হয়েছেন কর্মসংস্থান বিষয়ক সম্পাদক এবং বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি থোয়াই মহাজন হয়েছেন সদস্য।
অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ বিভাগের ৪৫ তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তর শেষ হয়েছে। পরীক্ষায় ফেল, রিটেক নেয়া সহ নানাভাবে ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখলেও বড়জোর ৪৪তম ব্যাচ পর্যন্ত ছাত্রত্ব আছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক সুত্রে জানা যায়। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কমিটির অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে স্থান পেয়েছে ৪২ ও ৪৩ তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।
বিভিন্ন সময়ে বহিস্কৃত ও বর্তমানে অছাত্রদের কমিটিতে পদ পাওয়া বিষয়ে জাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেল বলেন, মানুষ ভুল তো দুই-এক বার করতেই পারে। আমাদের তাদের সুযোগ দিতে হবে। আর কেন্দ্রীয় কমিটির জয় ভাই, লেখকদা যাকে ভালো মনে করছেন তাকেই কমিটিতে দিয়েছেন।
ক্যাম্পাসে রাজনীতি না করেও পদ পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজনীতি মানে তো প্রোটোকল দেয়া না। বিভিন্ন মিছিল মিটিংয়ে তো তাদের উপস্থিতি ছিল। আর কেন্দ্রীয় নেতারা যাকে যোগ্য মনে করেছেন কমিটিতে তাকেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
উল্লেখ্য যে, ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়া কেউ ছাত্রলীগের কমিটিতে পদ পাওয়ার যোগ্য নয় বলে বিবেচিত হবেন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা জেলা শাখার মর্যাদা পাবে এবং এর মেয়াদকাল এক বছর। এছাড়াও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১২১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠনের কথা থাকলেও এ কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন ৪০৫ জন।
পাঠকের মন্তব্য