মধুখালি চিনিকলের যন্ত্রাংশ চুরির তদন্ত নিয়ে ধুম্রজাল

রাষ্ট্রায়ত্ব চিনিকল বন্ধ

রাষ্ট্রায়ত্ব চিনিকল বন্ধ

অব্যাহত লোকসানের মুখে দেশের ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ব চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ২০২০ সালে রাজশাহী ও ফরিদপুর এই দুটি চিনিকলও বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। 

গত ৪৬ বছরে এই চিনিকলের লোকসানের পরিমাণ ৬৫৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। তবে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটির সাথে এখানে কর্মরত শ্রমিকদের কথা বিবেচনা করে পাঁচ বছরের একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করে। এরমধ্যে প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে লোকসানের দায় হতে লাভজনক করে তুলতে হবে। কর্তৃপক্ষ এখন সে চেষ্টাই চালাচ্ছেন জোরেসোরে। 

গত মৌসুমে আখের অভাবে মাত্র এক মাস দশদিন চলেছিলো আখ মাড়াই। এবার মৌসুমের চারমাসই আখ মাড়াইয়ের চিন্তাভাবনা রয়েছে সেভাবেই আখ চাষীদেরও প্রস্তুত করা হয়েছে। অন্যদিকে, ফরিদপুরের এই চিনিকলে দীর্ঘদিন ধরে যেই দুর্নীতি ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশ খুলে চুরির কথা উঠছিলো, সেব্যাপারেও কর্তৃপক্ষ শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়। 

ফরিদপুরে চিনিকলের ব্যবস্থপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ খবিরউদ্দিন মোল্যা সাংবাদিকদের জানান, চিনিকলের নিরাপত্তা বাড়াতে সার্চ লাইট লাগানো হয়েছে। সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। তবে মাঝমধ্যে সিসি ক্যামেরা নষ্ট হয়ে যায়। আর মিল থেকে যেনো কোনভাবেই কোন যন্ত্রাংশ বা মালামাল বের করতে না পারে সেজন্য সিকিউরিটিও বাড়ানো হয়েছে। 

এমডি খুব স্পষ্টভাবেই সাংবাকিদের জানালেন, তিনিই সিকিউরিটিদের নির্দেশ দিয়েছেন যেনো প্রতিটি গাড়ি তল্লাশি হয়, সকলের দিকে নজর দেয়া হয়।

এতোসব প্রস্তুতির মাঝেই গত মঙ্গলবার রাতে ফরিদপুর চিনিকল হতে চট্টগ্রামে সালফার আনতে যাওয়ার পথে গাইবান্ধা-উ-০০-০০০৩ নম্বরের একটি ট্রাকের টুলবক্স হতে একটি ফুয়েল পাম্প উদ্ধার করে মেইন গেটের সিকিউরিটি গার্ডরা। মেইন গেটের সিকিউরিটি গার্ড আঃ রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, আমার ডিউটি ছিলো বিকেল পাঁচটা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত। তখন তিনটা গাড়ি যাবে চিটাগাং সালফার আনতে। 

একটা বেরিয়ে গেছে ১২ টার দিকে। আর দুইটা গাড়ি বের হচ্ছে রাত ৯টা ১৫ মিনিটের দিকে। একটা গাড়ি বেরোয় গেছে চেক ছাড়াই। পরের গাড়ি চেক করে টুলবক্সে একটা মাল পাই। তারপরে সেই নিয়ে এমডি মহোদয়, প্রশাসন ব্যবস্থাপক সিকিউরিটি অফিসার অনেকেই আইছে। পরে আমি আর শাজাহান রাত দুইটা তিনটার দিকে বাসায় গেছি। 

তিনি বলেন, পরেরদিন এমডি মহোদয় আমাকে ডাকেন। তিনি তাড়াতাড়ি সিকিউরিটি গার্ড শাহাজানকে নিয়ে তার অফিসে যেতে বলেন। তখন আমি আর শাজাহান এমডি মহোদয়ের অফিসে গেলে স্যারকে না পেয়ে তিনি কোথায় জানতে চাই। তিনি আমাদের সিকিউরিটি অফিসারের রুমে বসতে বলেন। তখন সেখানে উপস্থিত ট্রাকচালক মোখলেস তাকে দেখে বলে, এই ... বাচ্চা, .... হারামির বাচ্চা, ....বাচ্চা, তুই আমার গাড়ি সিকিউরিটি গার্ড দিয়ে চেক করালি ক্যা? এই বলে সে আমাকে সাত-আটটি চড় মারে।

এ ঘটনার পর তৎক্ষণাত ট্রাক চালক মোখলেসুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তবে পরেরদিন ট্রাকচালকেরা আর ট্রাক চলতে না দেয়ার ঘোষনা দিলে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ওই সাময়িক বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানান। 

ফরিদপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ খবিরউদ্দিন মোল্যা ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে অভিযুক্ত ওই ট্রাকচালককে সাময়িক বহিষ্কারের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তবে তিনি এও জানান, পরেরদিন অন্য চালকেরা ট্রাক চালাতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি কাজ চালু রাখার স্বার্থে ওই বহিস্কারাদেশ তুলে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করে দেন। তবে এ ঘটনায় তিনি পুলিশকে জানাননি। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এই খবর সংগ্রহের সময় ট্রাকচালক মোখলেস সালফার আনতে চট্টগ্রামের পথে ছিলো। তাই তার বক্তব্য জানা যায়নি। তবে সেখানে উপস্থিত সিবিএ সভাপতি আব্বাস আলীর সাথে কথা হয়। তিনি বক্তব্যের শুরুতেই নিজের পরিচয় জানান এভাবে, 'আমরা ফরিদপুর চিনিকল  ইউনিয়নের নির্বাচিত সভাপতি। আমরা শ্রমিক লীগের একজন সদস্য। ফরিদপুর মধুখালী পৌরসভার একজন আমি সম্পাদক পোস্টে আছি আওয়ামী লীগের।' 

আব্বাস আলী বলেন, খবর পেয়ে সরেজমিনে এসে চিনিকলের ইঞ্জিনিয়ার ও ফোরম্যানকে ডাকি। তাদের নিয়ে আলোচনা করি। তারা আমাদের জানায়, এই পাম্পটি আমাদের মিলের না এবং এই কোয়ালিটির পাম্প আমাদের মিলে কখনোই আসে নাই। আব্বাস আলী বেশ জোরালো কন্ঠেই এভাবে মোখলেসের পক্ষাবলম্বন করে ফুয়েল পাম্প উদ্ধারকারী নিরাপত্তা রক্ষীদের বিরুদ্ধে তদন্তের কথাও জানান। 

তিনি বলেন, যখন জানলাম এটি আমাদের মিলের না তখন আমরা বিষয়টি নিয়ে আরেকটু দুশ্চিন্তায় ভুগি যে কারখানার মধ্যে এই মাল কি করে আসলো? তিনি বলেন, এই ফরিদপুর চিনিকলে আমাদের ডিউটি ২টার পরে শ্রমিক কর্মচারীরা যাওয়ার পরে সিকিউরিটিরা দ্বায়দ্বায়িত্বে থাকে। সকল জিনিস তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। যেখান থেকে এই মালটা দেখা গেছে সেই পয়েন্টে একজন লোক দেখা গেছে। সেখানে দুইজন লোক থাকে। 

এইটা বাইরে থেকে কিভাবে আসলো এটা সেখানে সিকিউরিটিরা যারা ডিউটিরত ছিলো, তাদেরকে এই তদন্ত কমিটির মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলছি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে। যেহেতু এই মিলে এই কোয়ালিটির পাম্পই নাই, তাহলে এই পাম্প গাড়ির মধ্যে কিভাবে আসবে? আর গাড়িটা যখন আউট হবে, তখন গাড়িটা বেরোনোর আগেই, এই গাড়ির যে ড্রাইভার সে প্রায় ৩০ বছর কর্মরত আছে। এবং বাইরের ভিতরের যতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমরা তাকে দিয়ে করাই। 

ফরিদপুর চিনিকলের সব যন্ত্রপাতি লাল রঙের দাবি করে উদ্ধার হওয়া ফুয়েল পাম্পটি সাদা রঙের বলে জানান আব্বাস আলী। তবে উদ্ধার হওয়া ফুয়েল পাম্পটি ঘষে লাল রঙ তুলে ফেলার চেষ্টার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেটির গায়ে এখনো কিছু রঙ অবশিষ্ট লেগে রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চুরি হওয়া এসব মালামাল মিলের পরিবহন প্রকৌশল বিভাগের দ্বায়িত্বে থাকে। ওই বিভাগের ব্যবস্থাপক এ কে এম কামরুল হাসানের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি এমডি স্যারের অনুমতি ছাড়া কিছু বলতে রাজি হননি। আবার একপর্যায়ে এ ঘটনায় যারা সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন তারাই জড়িত বলে পাল্টা অভিযোগ করেন।  

   


পাঠকের মন্তব্য