লক্ষীপুরে ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচিতে লুটপাটের মহোৎসব

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলায় ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচির নামে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) অফিস-ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতিরা পকেট ভারি করার পাঁয়তারা করছে। নামে মাত্র কাজ দেখিয়ে প্রায় ৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা লুটপাটের মহাউৎসবের প্রস্তুতি চলছে। কাজ না করে এ ভাবে সরকারি টাকা এই লুটপাট কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছেনা সচেতন মহল। একই রাস্তায় প্রতি বছর প্রকল্প দেখিয়ে সরকারি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা চালচ্ছেন তারা। 

এবার কর্মসূচির টাকা দিয়ে চেয়ারম্যান- মেম্বাররা তাদের বাড়ীর দরজা সংস্কার করারও অভিযোগ রয়েছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সরেজমিনে পরিদর্শন না করে পার্সেন্ট গ্রহন করে এসব অনিয়মের বৈধতা দিচ্ছেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

সরজমিন উপজেলার চরগাজী, চরপোড়াগাছা, বড়খেরী, চরআব্দুল্লাহ, চররমিজ, চর আলগী, চর আলেকজান্ডার, চররমিজ ও চরবাদাম ইউনিয়ন ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রামগতি উপজেলায় গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে ৩০৫২ জন শ্রমিকের বিপরীতে ৪ কোটি ৮৮ লাখ ৩২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। এই টাকা লুটপাট করার জন্য উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার যোগসাজশে ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা তাদের অনুসারীদের শ্রমিক বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করছেন। তবে ইউএনও বলছেন, অনিয়ম করার কোনো সুযোগ নেই। অনিয়মের অভিযোগ পেলেই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

উপজেলা পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অতিউৎসাহী হয়ে চেয়ারম্যান ও পরিষদের সদস্যরা তাদের অনুসারীদের দিয়ে ইউনিয়নব্যাপী শ্রমিকদের তালিকা করান। পরে তা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে দাখিল করা হয়। এতে গোটা উপজেলায় ৩০৫২ জন শ্রমিকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তালিকায় থাকা শ্রমিকদের কোনো কাজে ব্যবহার না করে ভেকু মেশিনে মাটি ভরাট করেন ইউপি চেয়ারম্যানরা। এমনকি তালিকায় শ্রমিকের নাম থাকলেও তারা এ সম্পর্কে কিছুই জানে না এমন অভিযোগও রয়েছে শতাধিক শ্রমিকের। আবার একই রাস্তায় বার বার প্রকল্প দিয়ে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। 

রামগতিতে ৪০ দিনের কর্মসূচির নামে চলছে সরকারি টাকা লুটপাটের এক মহাউৎসব।আর এই লুটপাটের মুল হোতা হিসেবে রয়েছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম নিজেই।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের শুরুতেই হতদরিদ্রদের জন্য আসা ৪০ দিনের কর্মসূচি প্রকল্প নিয়ে পিআইও এবং ইউপি চেয়ারম্যানদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। চেয়ারম্যানরা এবার কাজ করবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন পিআইওকে। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন প্রত্যেক শ্রমিকের নামে আলাদা আলাদা মোবাইল অ্যাকাউন্টে টাকা দেয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে কোনো শ্রমিক টাকা পায়না। এই নিয়েই মূলত চেয়ারম্যান ও পিআইওর মতবিরোধ দেখা দেয়। পরে বিষয়টি সমাধান হওয়ার পর কাজ শুরু করেন ইউপি চেয়ারম্যানরা।এতে তালিকাভুক্ত শ্রমিকরা কাগজ-কলমেই রয়েছেন। কর্মসৃজন কর্মসূচির টাকা যাবে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের পকেটে। আর এতে বিশাল একটি অংশ যাবে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার পকেটে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় তালিকায় থাকা কোনো প্রকল্পেই শ্রমিক পাওয়া যায়নি। কিছু কিছু প্রকল্পে ভেকু মেশিনেই মাটি কাটা হচ্ছে। তাতেও নয়ছয় করে যেন সরকারি টাকা লুটপাটের এক মহোৎসব চলছে। শ্রমিক নেই, কিন্তু মোবাইল অ্যাকাউন্টে শ্রমিকের নাম ব্যবহার হচ্ছে ঠিকই। শ্রমিকের নামে অ্যাকাউন্ট থাকলেও টাকা যাবে প্রকল্প সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যানদের কাছে। শ্রমিকের নামের সকল সিম সব চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের কাছে। শ্রমিকরা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না।

এক ইউপি সদস্য নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, কাজ হোক বা না হোক শতকরা ২৫ পার্সেন্ট টাকা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিসকে দিতে হবে। টাকা না দিল অর্থ ছাড় হবে না। এমন অভিযোগ প্রায় সবকটি প্রকল্প সভাপতি, ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের।

সবচেয়ে বেশী অনিয়ম হচ্ছে উপজেলার চরবাদাম,চরআলগী ও চরআলেকজান্ডার ইউনিয়নের প্রকল্পগুলোতে। এতে নামে মাত্র কাজ করে টাকা লুটপাটের পাঁয়তারা চলছে। চরবাদাম ইউনিয়নের রফিক, বালুচর এলাকার বাসিন্দা রায়হান ও চরগাজীর তেগাছিয়া এলাকার ইলিয়াস বলেন,আমরা শ্রমিক দেখিনি। 
ভেকু মিশিনে সামান্য মাটি ফেলেছে।

কয়েকজন প্রকল্প সভাপতি জানান, পিআইও ও চেয়ারম্যানরা যেভাবে বলছেন, তারা সেভাবেই কাজ করছেন। আর কমিশন বাণিজ্যের কারণে শতভাগ কাজ করতে হিমশিম খেতে হয় বলে অভিযোগ করেন তারা।

কমিশন দেয়ার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে চরআব্দুল্লাহ ইউপি চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীন মঞ্জু, চরপোড়াগাছা ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন হাওলাদার বলেন, সরকারি বরাদ্দকৃত অল্প টাকায় রাস্তা নির্মাণ সম্ভব নয়। আর ৪০০ টাকা দিয়ে শ্রমিক পাওয়া যায় না। তাই ভেকু মেশিনে মাটি ভরাট করেন তারা। এবং এবিষয়ে সংবাদ প্রকাশ না করতে সাংবাদিকদের অনুরোধ করেন তারা।

রামগতি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) জহিরুল ইসলামের অফিসে একাধিকবার গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। বক্তব্য দিতে নানা তালবাহানা করে দেখা করবেন বলে শুধু সময় পার করেন। পরে ফোন করলে তিনি বলেন,যে যত টাকার কাজ করবেন,তাকে সেই পরিমাণ বিল দেওয়া হবে। 

 রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম শান্তনু চৌধুরী বলেন, কর্মসৃজন কর্মসূচি নিয়ে অনিয়ম করার কোনো সুযোগ নেই। সরেজমিনে তদন্ত করে বিল ছাড় দেয়া হবে।

লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোসেন আকন্দ বলেন, শ্রমিকের অধিকার নিয়ে নয়ছয় করার কোনো সুযোগ নেই। কমিশন বাণিজ্যসহ সব ধরনের অনিয়ম খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

   


পাঠকের মন্তব্য