একজন কৃষিবিদ মোঃ আদনান বাবু : নন্দীগ্রামের কৃষি ও কৃষক

কৃষিবিদ মোঃ আদনান বাবু

কৃষিবিদ মোঃ আদনান বাবু

পুরো নাম কৃষিবিদ মোঃ আদনান বাবু। বর্তমানে উপজেলা কৃষি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলায়। ৩১তম বিসিএস (কৃষি) ব্যাচের এই কর্মকর্তা ২০২০ সনের ফেব্রুয়ারিতে যোগদানের পর থেকেই গতানুগতিক কৃষি সেবা প্রদানের চেয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে সেবা প্রদানের বিষয়ে ভাবতে থাকেন যাতে করে সেবা গ্রহীতাদের সময়, শ্রম এবং ভোগান্তি কম হয়।  

এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাধারণ কৃষি সেবার পাশাপাশি ৫ (পাঁচ) টি বিশেষ কৃষি সেবা হিসেবে চালু করেছেন ‘প্ল্যান্ট ডক্টর মোবাইল টিম’, ‘ছাদ কৃষি লার্নিং সেন্টার’ ‘ফারমার্স আইটি স্কুল’ ‘ভ্রাম্যমান কৃষি পাঠাগার’ এবং ‘কৃষকের গল্প’ শিরোনামে অনলাইন ভিত্তিক ইউটিউব চ্যানেল এবং ফেসবুক পেজ। ‘প্ল্যান্ট ডক্টর মোবাইল টিম’ একটি বিশেষ কৃষক সেবা কার্যক্রম। এই টিমের প্রধান কাজ ভ্রাম্যমান কৃষি সেবা প্রদান করা। সেবাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফসলের রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনে প্রেসস্ক্রিপশন দেয়া, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও জাত সম্প্রসারণ, কৃষি আবহাওয়া সম্পর্কে সচেতন করা, নিরাপদ ও জৈব কৃষি উপকরণ প্রদর্শণ, কৃষি উদ্যোক্তা গঠন, কৃষি লিফলেট বিতরণসহ আধুনিক ও রপ্তানীমূখী কৃষি গড়ে তোলা। 

এই মোবাইল টিমে নিয়মিত যুক্ত আছেন কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার অপূর্ব ভট্টাচার্য্য, মোঃ রুহিদ হাসান, উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ অফিসার মোঃ নজরুল ইসলাম এবং সংশ্লিষ্ট ব্লকের উপসহকারী কৃষি অফিসার। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এই মোবাইল টিমে যুক্ত থেকে সেবা প্রদান করে থাকেন কৃষি বিশেষজ্ঞগণ। প্রতি সপ্তাহের একটি নির্র্দিষ্ট দিনে একটি ইউনিয়নের কৃষকদের দিনব্যাপী সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ইউনিয়ন পরিষদ চত্ত্বর, হাট-বাজারের পাশে, রাস্তার মোড়ে যেখানে কৃষকদের জমায়েত বেশী হয়  এমন জায়গা গুলোতে ‘প্ল্যান্ট ডক্টর মোবাইল টিম’ কৃষি সেবা প্রদান করে থাকে। 

এছাড়াও এই টিম মাঠে কর্মব্যস্ত কৃষকদের সরাসরি উপস্থিত থেকে দন্ডায়মান ফসলের বিভিন্ন রোগ-বালাই ও পোকামাকড় দমনে পেসস্ক্রিপশনসহ কৃষি বিষয়ক পরামর্শ প্রদান করে থাকে। যেকোন কৃষক-কৃষানী তার কৃষি বিষয়ক সমস্যা নিয়ে হাত তুললেই থেমে যায় গাড়ী এবং কৃষি সেবা প্রদান করে। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষকসহ নানা শ্রেণীপেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ২,০০০ কৃষক-কৃষানী এই সেবার আওতায় এসেছেন এবং এটি অব্যাহত আছে।মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী ঘোষনা প্রতি ইঞ্চি জায়গা আবাদের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে সকলকে উৎসাহিত করার জন্য এবং ছাদকৃষিকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে উপজেলা কৃষি অফিস, নন্দীগ্রাম, বগুড়ার অফিস ভবনের ছাদে স্থাপন করা হয়েছে ছাদ কৃষি লার্নিং সেন্টার। 

এক সময়ের খালি ছাদ এখন দৃষ্টিনন্দন ছাদকৃষির আওতায়। এখানে বিভিন্ন ধরনের দেশী-বিদেশী ফল, ফুল, সবজি ও শোভাবর্ধনকারী গাছ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে লাগানো হয়েছে। প্রতিটি গাছের সাথে বাংলা নাম, ইংরেজি নাম এবং বিশেষ গুনাগুণ/বৈশিষ্ট্যসহ নেমপ্লেট লাগানো রয়েছে। যেখানে একজন দর্শনার্থী একা এক ঘুরে ঘুরেই নানা কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে জানছেন এবং শিখছেন। এছাড়াও রযেছে ছাদকৃষি শুরু করার প্রাথমিক করনীয় এবং প্রাথমিক উপকরণ কর্ণার যেখানে যেকোন দর্শনার্থী খুব সহজেই বিভিন্ন উপকরণ সম্পর্কে বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান লাভ করতে পারছেন। 

এছাড়াও পরিত্যক্ত বোতল/বস্তা ব্যবহার করে খুব সহজেই সেগুলোকে কিভাবে চাষের আওতায় নিয়ে আসা যায় সেই অভিনব প্রযুক্তিগুলোও এখানে প্রদর্শন করা হচ্ছে। পুরো ছাদকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সবজি কর্ণার, ফুলের কর্ণার এবং ফলের কর্ণার। সবজি কর্ণারে লাগিয়েছেন করলা, চিচিঙ্গা, টমেটো, বেগুন, মরিচ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, শসাসহ নানা রকম সবজি। এই সবজি গুলোর মাচা তৈরী করা হয়েছে একটু ভিন্নভাবে। স্বাভাবিক মাচার পরিবর্তে এখানে ”অ” প্যাটার্নের মাচা তৈরী করা হয়েছে যার ফলে অল্প জায়গাতেই অধিক সবজি চাষ করা সম্ভব হয়েছে। ফুলের কর্ণারে শোভা ছড়াচ্ছে পয়েনসেটিয়া, অ্যাজিলিয়া, সিজিয়াম, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, পিটুনিয়া, গাঁদা, বেলী, নয়নতারা, কমলা রঙ্গন, লাল রঙ্গন, জবা, স্থল পদ্ম, বাগান বিলাস, পাতাবাহার, ক্যাকটাস সহ শোভাবর্ধনকারী হরেক রকম গাছ। ফলের কর্ণারে রয়েছে বারমাসী আম, জাম্বুরা, জলপাই অগ্নিশ^র কলা, থাই পেয়ারা, দেশী মাল্টা, আমড়া, কামরাঙ্গা, লেবু, কদবেল, কট লেবু, সুইট লেমন, সরিফাসহ নানা প্রজাতির ফলগাছ। বিদেশী ফলগাছের উপস্থিতি ও চোখে পড়ার মতো। রয়েছে ড্রাগন, চাইনিজ কমলা, ভেরিগেটেড মাল্টা ইত্যাদি। প্রতিদিনই এখানে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ, কৃষি সেবাগ্রহীতা, ছাত্র-ছাত্রীসহ অনেকেই আসছেন। তারা এই সেন্টারটি ঘুরে ঘুরে দেখছেন এবং মুগ্ধ হয়ে নিজেরাও ছাদকৃষি করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এই সেন্টারে ছাদ কৃষির পাশাপাশি মাঠ কৃষিরও নানা আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় তিন শতাধিক সেবা গ্রহীতা সেন্টারটি পরিদর্শন করেছেন।

আইটি সম্পর্কিত কৃষি সেবাগুলো সহজে প্রাপ্তির জন্য নন্দীগ্রামে তার উদ্যোগে চালু হয়েছে ফারমার্স আইটি স্কুল। ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি সেবা কার্যক্রমকে আরো সহজীকরণ করতে কাজ করছে এই স্কুল। এতে একদিকে কৃষি সেবা পেতে সময় এবং শ্রম কম লাগছে অপরদিকে সেবাগ্রহীতাদের ভোগান্তিও কম হচ্ছে। প্রতি মাসের ১ম কর্মদিবসে তত্ত্বীয় এবং ব্যবহারিক সেশনের মাধ্যমে স্কুলটি পরিচালনা করা হয়। নির্ধারিত দিনে সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এই স্কুলে কৃষি ভিত্তিক আইটি প্রযুক্তির উপর সেশন পরিচালনা করেন উপজেলা কৃষি অফিসার এবং কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার। 

কৃষকসহ যেকোন কৃষি অনুরাগী ব্যক্তি এই সেবা গ্রহন করতে পারেন। তবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রথমে প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে একজন করে তরুণ, আগ্রহী এবং উদ্যোমী শিক্ষিত কৃষক ছাত্র হিসেবে নির্বাচন করা হয়। এরপর তাদেরকে খুব যতœ সহকারে কৃষি আইটি সম্পর্কিত বিষয়গুলো শেখানো হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রতিজন কৃষককে দায়িত্ব দেয়া হয় পরবর্তী এক মাসের মধ্যে দশজন করে নতুন কৃষককে প্রশিক্ষনলব্ধ জ্ঞান সরবরাহের মাধ্যমে তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা। এভাবে প্রতি মাসে ষাট জন করে কৃষক এই সেবার আওতায় আসছে। এখানে কৃষি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে কিভাবে কৃষি সেবা পাওয়া যায় তা হাতে কলমে শেখানো হচ্ছে। কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন অ্যাপ ডাউনলোড করে কিভাবে সেবা পাওয়া যায় তা দেখানো হচ্ছে। অনলাইন ভিত্তিক কৃষি সেবা যেমন অনলাইনে সার সুপারিশ, হটলাইন নাম্বারে ফোন দেয়া, অনলাইনে কৃষি আবহাওয়া বার্তা, ভিডিও কলিং, কৃষি ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হওয়াসহ নানা অনলাইন ভিত্তিক কৃষি সেবাগুলো এখানে শেখানো হচ্ছে। সার্বিকভাবে স্মার্ট কৃষি এবং কৃষক গড়ে তুলতে কাজ করছে এই ফারমার্স আইটি স্কুল। কৃষির নানা আধুনিক তথ্য এবং প্রযুক্তিগুলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে আদনান বাবুর আরো একটি ভিন্নধর্মী উদ্যোগ ভ্রাম্যমান কৃষি পাঠাগার। উপজেলা কৃষি অফিস চত্ত্বরে সপ্তাহে একদিন করে বসে এই কৃষি পাঠাগার। প্রায় ৬(ছয়) শতাধিক বই এবং পুস্তিকার সমন্বয়ে যাত্রা শুরু করেছে পাঠাগারটি। এই পাঠাগারে বসে বই পড়ার যেমন সুযোগ রয়েছে তেমনি বাড়ীতে নিয়ে গিয়েও বই পড়া যাবে। তবে সর্বোচ্চ সাত দিন পর সেটি আবার ফেরত দিতে হবে। 

এছাড়াও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরকে কৃষিতে আগ্রহী করার জন্য এই ভ্রাম্যমান কৃষি পাঠাগারটি বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ক্যাম্পাসে যাচ্ছে এবং তাদের কৃষি বই পড়ায় উৎসাহিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে।  কৃষি পাঠাগারে উপস্থিত কৃষক মোঃ আফজাল হোসেন জানান, এ রকম পাঠাগার থাকায় আমরা খুব সহজেই কৃষির নানা জ্ঞান অর্জন করতে পারছি। চাকলমা গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা মোঃ জাব্বির হোসেন জানান, এ রকম একটি চমৎকার উদ্যোগ গ্রহন করায় আমরা খুবই আনন্দিত। খুব সহজেই আমরা আধুনকি কৃষির নানা দিক জানতে পারছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে তিনি কৃষি ও কৃষকের অনলাইন ভিত্তিক কৃষি সেবা প্রদানের লক্ষ্যে গঠন করেছেন ‘কৃষকের গল্প’ শিরোনামে ইউটিউব চ্যানেল এবং ফেসবুক পেজ। এখানে বিভিন্ন সফল কৃষকের সফলতার গল্পের ভিডিও ডকুমেন্টারি, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ, সমসাময়িক কৃষি,  প্রশ্নোত্তর পর্বসহ নানা কৃষি বিষয়ক আলোচনা করা হয় যাতে করে অনলাইন ব্যবহারকারী কৃষি অনুরাগী ব্যক্তিগণ খুব সহজেই তাদের কৃষি সমস্যার সমাধান পাচ্ছেন। 

এই দুটি মাধ্যমে প্রায় ২০,১০০ এর মতো কৃষক এবং কৃষি অনুরাগী মানুষ সরাসরি যুক্ত আছেন। এখানে এখন পর্যন্ত ৬৩ টি কৃষি ডকুমেন্টারী রয়েছে যার মধ্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এবং জৈব কৃষির উপর রয়েছে একাধিক ডকুমেন্টারী। এই চ্যানেলের বিভিন্ন প্রোগ্রাম ইতোমধ্যে ১১ (এগারো) লক্ষাধিক মানুষ দেখেছে এবং এটি আরো জনপ্রিয় হচ্ছে। এছাড়াও বিভাগীয় কর্মকান্ডের মাধ্যমে তিনি নন্দীগ্রামের কৃষিতে যুক্ত করে চলেছেন নানা ধরনের নতুন নতুন ফসল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্ট্রবেরী, সৌদী খেজুর, সূর্যমূখী, অফসিজন তরমুজ। তার হাত ধরেই নন্দীগ্রামে তৈরী হচ্ছে অনেক সফল কৃষি উদ্যোক্তা। এছাড়াও নিরাপদ ও জৈব সবজী উৎপাদনের জন্য জৈব সার,  ভার্মি কম্পোস্ট, ট্রাইকো-কম্পোস্ট উৎপাদন বেড়েই চলছে। করোনাকালে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য স্থাপন করেছেন পারিবারিক পুষ্টি বাগান। পুকুড়ের পাড়কে কাজে লাগিয়ে আবাদ করা হচ্ছে নানা ধরনের সবজি।  

এ বছর নন্দীগ্রামে রেকর্ড পরিমান জমিতে সরিষা আবাদসহ আউশের আবাদ সম্প্রসারণ, মরিচ, বেগুন, শসা, লাউ,ফুলকপি, বাধাকপি, শসা, ক্ষীরা, মিষ্টি কুমড়াসহ নানা ফসলে সমৃদ্ধ হচ্ছে নন্দীগ্রামের কৃষি। সার্বিকভাবে উপজেলা কৃর্ষি অফিসার মোঃ আদনান বাবুর নানা উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো কৃষি বিভাগ এবং কৃষকদের মাঝে সেবা আদান-প্রদানের এক নিবিড় সংযোগ স্থাপন করছে। 

   


পাঠকের মন্তব্য