আইকনিক সিঙ্গার নূরজাহানে পাগল হয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান

মিলি সুলতানা, সুলেখক ও শব্দ চৈতন্যের কারিগর

মিলি সুলতানা, সুলেখক ও শব্দ চৈতন্যের কারিগর

মিলি সুলতানা : উপমহাদেশের আইকনিক সিঙ্গার মালিকা-ই- তারান্নুম নূরজাহানের চোখ ঝলকানো সৌন্দর্যে পাগল হয়েছিলেন পাক শাসক ইয়াহিয়া খান। এমনকি ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খানও নূরজাহানের জন্য পাগল ছিলেন। জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার বরাত দিয়ে জানা গিয়েছিল নূরজাহানের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন আইয়ূব খান। মালিকা-ই-তারান্নুমের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান উতলা হয়ে পড়েছিলেন। ইয়াহিয়া নূরজাহানকে ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। 

পাকিস্তানি চলচ্চিত্র অভিনেত্রী রানি ছিলেন ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইয়াহিয়া যখন মন্ত্রীসভার বৈঠক ডাকতেন, রানিকে সাথে রাখতেন। রাজনীতি নিয়ে ইয়াহিয়ার কানে বহু কুমন্ত্রণা দিতেন রানি। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে যখন গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে রাখা হয়, ইয়াহিয়া মন্ত্রীসভার কেবিনেটে আর্জেন্ট মিটিং ডাকলেন। তার ইস্যু ছিল শেখ মুজিবকে নিয়ে কি করা যায় ? 

এ বিষয়ে মন্ত্রীরা বিভিন্ন মতামত দিয়েছিল। শুধু একজন ছাড়া কারো মন্তব্যই ইয়াহিয়ার ভালো লাগেনি। সবাই মতামত দিয়েছিল এই বলে, বঙ্গবন্ধুকে জেলে পুরে রাখা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা। কেউ তাঁকে ছেড়ে দেয়ার পক্ষে মতামত দেন। কিন্তু রানি খুবই উগ্রমূর্তি ধারণ করে সবাইকে বিরোধিতা করে বলেন, "উসকো ফাঁসি মে লাটকা দো, ঝাঞ্জাট খতম (তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দাও, ঝামেলা শেষ)"!! সেদিন প্রিয় বান্ধবীর বচন শুনে ইয়াহিয়া অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। রানিকে বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করেছেন। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুবাদে আগে থেকেই রানির সাথে নূরজাহানের সখ্যতা ছিল। ইয়াহিয়া রানির কাছে আবদার করলেন নূরজাহানকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। 

একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত হয়েছিল হামুদুর রহমান কমিশন। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট চেয়ারে বসেই সারাদিন মদে বুঁদ হয়ে থাকতেন। ইয়াহিয়ার সঙ্গে অজস্র নারীর সম্পর্ক ছিল। তাদের তালিকাও বানানো হয়েছিল। তালিকার শীর্ষে ছিলেন নূরজাহান। নূরজাহানকে "নূরি" বলে ডাকতেন ইয়াহিয়া। আর তিনি ইয়াহিয়াকে ‘'সরকার’' বলে সম্বোধন করতেন। 

অভিনেত্রী রানি তার বাসায় একদিন তার বাসায় ইয়াহিয়া নূরজাহানের একান্তে মোলাকাতের ব্যবস্থা করে দেন। নূরজাহানের জনপ্রিয়তা তখন আকাশচুম্বী। সেদিন রানির বাসায় নূরজাহানকে নিয়ে ৭ ঘন্টা সময় কাটিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। তবে এক সময় তাদের মেলামেশা রানিকে জেলাস করতো। যখন দেখলেন নূরজাহানের জন্মদিনে ইয়াহিয়া তাকে দুম করে ৩২ ভরি স্বর্ণালংকার উপহার দিলেন। যা দেখে রানির চক্ষু চড়কগাছ। শুধু তাই নয় নূরজাহানের মেলোডি ভয়েস শুনে খুশি হয়ে তাকে ৫৫ হাজার রুপি উপহার দেন। সেই সময়ে একসাথে এত স্বর্ণালঙ্কার এবং নগদ টাকা চাট্টিখানি কথা নয়। নূরজাহান শখ করে প্রায়ই টায়রা পরতেন। খোঁপায় স্বর্ণের মালা গেঁথে রাখতেন। 

জানা যায়, সেগুলো ছিল ইয়াহিয়ার দেয়া উপহার। সেই থেকে রানির সাথে নূরজাহানের সম্পর্ক শীতল রূপ ধারণ করে। রানি নূরজাহান বিদ্বেষী হয়ে উঠলেন। ক্ষুব্ধ হয়ে পত্রিকায় ইন্টারভিউ দিলেন ইয়াহিয়া নূরজাহানের অবাধ মেলামেশা নিয়ে। ৭ ঘন্টা পর বন্ধ কামরা থেকে বের হয়ে নূরজাহান টালমাটাল ছিলেন। ইয়াহিয়া তাকে মদ খাইয়ে মাতাল করে দিয়েছিলেন। এভাবে অনেকদিন চলেছিল ইয়াহিয়া নূরজাহানের প্রেম কাহিনী। 
 
নূরজাহান তার দুই ছেলে চার মেয়েকে মেয়েদেরকে বোর্ডিং স্কুলে পড়াতেন। বাসায় সুরেলা মহল বিরাজ করতো বলে সন্তানদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত যাতে না ঘটে সেজন্য বোর্ডিং স্কুলের ব্যবস্থা ছিল। সন্তানদের বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে অঝোরে কাঁদতেন। বিশাল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন তিনি। নূরজাহানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি বোর্ডিং স্কুলে মেয়েদের জন্য ট্রাক ভর্তি করে ফল মিষ্টি বিরিয়ানি পাঠাতেন। ট্রাক বোঝাই করে খাদ্য পাঠানোর কারণ হল পুরো বোর্ডিং স্কুলের ছাত্রছাত্রী শিক্ষক শিক্ষিকা পিয়ন কর্মচারী কেউই বাদ যাবেনা। প্রিন্সিপালকে চিঠি লিখে পাঠাতেন নিজের হাতে। মালিকা-ই- তারান্নুমের লেখা চিঠি পেয়ে প্রিন্সিপাল ধন্য হয়ে যেত। নূরজাহানের নির্দেশ ছিল, বোর্ডিং স্কুলের কেউ যেন খাওয়া দাওয়া থেকে বাদ না পড়ে। 

নূরজাহান তার জীবদ্দশায় দুই বিয়ে করেছিলেন। ১৯৪২ সালে তিনি চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ শওকত হুসেন রিজভীকে প্রথম বিয়ে করেছিলেন। রিজভীর সাথে তার তিনসন্তান জন্ম নেয়-আকবর হোসেন রিজভী, আসগর হুসেন রিজভী এবং কন্যা জিলে হুমা। রিজভীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনি পাকিস্তানের জননন্দিত অভিনেতা ও পরিচালক এজাজ দুররানিকে বিয়ে করেন ১৯৫৯ সালে। তবে ১৯৭১ সালে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। ইজাজের সাথে তার তিন মেয়ে জন্ম নেয়- হিনা দুররানি, নাজিয়া ইজাজ খান এবং মিনা হাসান। ইজাজের চেয়ে ১০ বছরের বড় ছিলেন নূরজাহান। তবে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদও হয়ে যায়। নূরজাহানের বড়মেয়ে জিলে হুমা গায়িকা ছিলেন। তিনি দেখতে হুবহু মায়ের মত ছিলেন। হুমা ডায়াবেটিস উচ্চরক্তচাপ এবং কিডনি ফেইলিউরে মারা গেছেন ২০১৪ সালে। এছাড়া তার পায়ে গ্যাংরিনও হয়েছিল। 

গহনা থেকে মেকআপ চুল সবকিছুর মধ্যে নূরজাহানের সৌন্দর্য নিখুঁতভাবে পয়েন্ট আউট হত। ফ্যাশন সেন্সের জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। ২৩ ডিসেম্বর ২০০০ সালে হৃদরোগে মারা যান মালিকা-ই- তারান্নুম।

লেখক : মিলি সুলতানা
পরিচিতি : সুলেখক ও শব্দ চৈতন্যের কারিগর

   


পাঠকের মন্তব্য