জাতির পিতার জন্মদিনে যেভাবে জাতীয় শিশু দিবস প্রবর্তন হলো

যেভাবে জাতীয় শিশু দিবস প্রবর্তন হলো

যেভাবে জাতীয় শিশু দিবস প্রবর্তন হলো

মিয়া মনসফ : ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখার প্রত্যয় নিয়ে জাতীয় শিশু কিশোর সংগঠন বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৩রা আগষ্ট। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ৩০ জন বুদ্ধিজীবিদের উপদেষ্টা করে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে শিশু কিশোরদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। “ইতিহাসের সন্ধানে নতুন প্রজন্ম” কর্মসূচীর আওতায় শিশু কিশোরদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করার কর্মসূচি প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৮ বছর ধরে চলে আসছে। তম্মধ্যে ড. নীলিমা ইব্রাহিম প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা প্রবর্তিত বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জাতীয় শিশু দিবস অন্যতম।

বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার উপদেষ্টা, পৃষ্ঠপোষক ও কর্মকর্তাদের নিয়ে ২য় কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৩ সালের ২ নভেম্বর। ২য় কনভেনশনে উপদেষ্টাদের মধ্যে যারা ছিলেন তারা হলেন- মোঃ জিল্লুর রহমান, সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন, বিচারপতি কে এম সোবহান, শওকত ওসমান, এম আনিসুজ্জামান, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, কবি শামসুর রাহমান, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, কলিম শরাফী, ড. দুর্গাদাস ভট্টাচার্য, আলহাজ্ব মোহাম্মদ জহিরুল হক, খ ম হারুন, সারাহ বেগম কবরী, ড. ইনামুল হক, লাকী ইনাম, কবি রফিক আজাদ, রাহাত খান, আসাদ চৌধুরী, সেলিম নজরুল হকসহ আরো অনেকে। মেলার ভবিষ্যৎ সাংগঠনিক কর্মপরিকল্পনাসহ প্রথম জাতীয় সম্মেলন আয়োজনের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে ২য় কনভেনশনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

কনভেনশনের মাত্র কয়েকদিন পর বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার অস্থায়ী কার্যালয়ের ঠিকানায় মেলার উপদেষ্টা ড. নীলিমা ইব্রাহিম সভাপতির নামে একটি পত্র লিখেন। সভাপতিকে প্রীতিভাজনেষু সম্বোধন করে ড. নীলিমা ইব্রাহিম বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার মধ্যে দূরাগত আলোক রশ্মি দেখতে পাচ্ছেন বলে পত্রে উল্লেখ করেন। তিনি সংগঠনের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালনের জন্য প্রস্তাব করেন।

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালনের ড. নীলিমা ইব্রাহিমের স্বহস্তে লেখা প্রস্তাবনা পত্রটি হচ্ছে-  গত ১২.১১.৯৩ তারিখে আপনাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত শুধু হইনি, একটি দূরাগত আলোক রশ্মিও দেখতে পেয়েছি। আপনার প্রতিষ্ঠানের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি। 

আমি আপনার মাধ্যমে সংগঠনের কাছে একটি প্রস্তাব রাখতে চাই। আজ ১৪. ১১ তারিখ পন্ডিত জওহুর লালের জন্মদিন, সমগ্র ভারতে এ দিনটি শিশু দিবস রূপে পালিত হয়। আমি আপনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটিও যেন বাংলাদেশে শিশু কিশোর দিবস হিসেবে পালিত হয়। ঘোষণা দেবে আপনার প্রতিষ্ঠান, দেখবেন একে একে অনেকেই গ্রহণ করবে, আর তাপ চাপ সৃষ্ঠি করতে পারলে সরকারও নতি স্বীকার করবে। শুভেচ্ছান্তে- নীলিমা ইব্রাহিম।

ড. নীলিমা ইব্রাহিমের এই প্রস্তাব নিয়ে কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী কমিটির সভায় আলোচনা হয়। মেলার সকল কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার প্রথম জাতীয় সম্মেলনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে প্রস্তাবটি পাস করার পক্ষে মতামত দেন। একই সভায় প্রথম জাতীয় সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হয় ১৯৯৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর। সম্মেলনের আয়োজন করা হয় শিল্পকলা একাডেমী মিলনায়তনে। প্রধান অতিথি হিসেবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। সংগঠনের প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরে সারাদেশে গড়ে ওঠা ১১৬ টি শাখার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সম্মেলনের কার্যক্রম শুরু হয়। এক পর্যায়ে ড. নীলিমা ইব্রাহিম প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জাতীয় শিশু দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। জননেত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে কয়েক হাজার প্রতিনিধি ও আমন্ত্রিত অতিথিদের করতালির মধ্য দিয়ে জাতির জনকের জন্মদিনে জাতীয় শিশু দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ড. নীলিমা ইব্রাহিমের প্রস্তাবনায় জাতির পিতার জন্মদিনে জাতীয় শিশু দিবস পালনের বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার উদ্যোগকে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যে স্বাগত জানিয়ে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার প্রথম জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গঠিত নতুন কমিটি ১৯৯৪ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে প্রথম জাতীয় শিশু দিবস পালনের প্রস্ততি শুরু করে। প্রথম জাতীয় শিশু দিবস পালনের লক্ষ্যে ড. নীলিমা ইব্রাহিমের কাকরাইলস্থ বাসভবনে উপদেষ্টা ও কার্যকরী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন মেলার প্রধান উপদেষ্টা এম আনিসুজ্জামান। সভায় সর্ব সম্মতিক্রমে আওয়ামী সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। 

প্রথম জাতীয় শিশু দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানাতে ১৯৯৪ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেত্রীর মিন্টু রোডের বাসভবনে গিয়েছিলেন মেলার প্রধান উপদেষ্টা এম আনিসুজ্জামান, উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, আলহাজ্ব মোহাম্মদ জহিরুল হক, তৎকালিন সাধারণ সম্পাদক মিয়া মনসফ ও সাংগঠনিক সম্পাদক শিরিন আকতার মঞ্জু। মাননীয় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর পাশাপাশি জাতীয় শিশু দিবস জাতীয় পর্যায়ে পালনের জন্য একটি স্মারকলিপিও দেয়া হয়।

প্রথম জাতীয় শিশু দিবস আয়োজনের সব প্রস্তুতি যখন শেষ, তখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলীয় কর্মসূচীর কারণে প্রথম জাতীয় শিশু দিবস শেখ রেহানাকে দিয়ে উদ্বোধন করার কথা বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে জানান।

জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানাকে দিয়ে প্রথম জাতীয় শিশু দিবস উদ্বোধন করার পরামর্শ দিলে ড. নীলিমা ইব্রাহিমের নেতৃত্বে উপদেষ্টামন্ডলীর কয়েকজন সদস্যসহ মেলার কেন্দ্রীয় কর্মকর্তারা শেখ রেহানাকে আমন্ত্রণ জানাতে তাঁর গুলশানস্থ বাসভবনে যান। তিনি সাদরে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন।

১৯৯৪ সালের ১৭ মার্চ। ড. নীলিমা ইব্রাহিম প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা প্রবর্তিত প্রথম জাতীয় শিশু দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজন হয় বাংলাদেশ শিশু একাডেমীতে। সকাল ১০ টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। মেলার উপদেষ্টা আলহাজ্ব মোহাম্মদ জহিরুল হক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানাকে নিয়ে যখন অনুষ্ঠান স্থলে উপস্থিত হন তখন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানাকে শত শত শিশু কিশোর পুস্প বৃষ্টিতে সাদর আমন্ত্রণ জানায়। তারপর তিনি বেলুন উড়িয়ে ১ম জাতীয় শিশু দিবসের শুভ উদ্বোধন করেন এবং চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীদের সাথে কুশল বিনিময় করেন। এরপর তিনি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন। তৎকালিন মেলার সভাপতি মহিউদ্দিন মানুর সভাপতিত্বে প্রথম জাতীয় শিশু দিবসের উদ্বোধনী উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার উপদেষ্টা সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন, জাতীয় শিশু দিবসের প্রস্তাবক ড.নীলিমা নীলিমা ইব্রাহিম, প্রধান উপদেষ্টা এম আনিসুজ্জামান, কলিম শরাফি, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, মুস্তাফা সারওয়ার, পরিচালক বিমান ভট্টাচার্য।

উদ্বোধনী ভাষণ শেষে মেলার কেন্দ্রীয় শিল্পী পরিবেশিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন দু’সন্তান রেদওয়ান সিদ্দিক ববি ও টিউলিপ সিদ্দিকীসহ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে বঙ্গবন্ধুকন্যা অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করলেও বিকেলে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার বিতরণ করতে তিনি আবার অনুষ্ঠানে আসেন এবং বিজয়ী প্রতিযোগীদের পুরস্কার বিতরণ করেন। এভাবে ড. নীলিমা ইব্রাহিম প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা প্রবর্তিত বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে প্রথম জাতীয় শিশু দিবস পালিত হয়।  ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর জাতীয় শিশু দিবস সরকারী স্বীকৃতি পায়। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার গঠন করলে বঙ্গবন্ধুর দিনে জাতীয় শিশু দিবস বাতিল করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা ধারাবাহিকভাবে জাতীয় শিশু দিবস পালন করে আসছে।

২০০১ সালে ষড়যন্ত্রের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতা হারালে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উপর অত্যাচার খড়গ নেমে আসে। বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার মতো শিশু সংগঠন টিকে থাকা তখন কঠিন ছিল। কিন্ত মেলার সারাদেশের উদ্যোমী নেতাকর্মীদের সাহসী ভূমিকায় দিবসটি ধারাবাহিকভাবে পালন করা হয় বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার আয়োজনে। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সরকারীভাবে আজ অবধি দিবসটি পালিত হচ্ছে। 

এবছর জন্মবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা ৩০ তম জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করবে। এবছর বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও ৩০তম জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা সারাদেশে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আলোচনা, চিত্রাংকন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা।
                                        
মিয়া মনসফ
সভাপতি
কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা
মোবাইল- ০১৭১৮৭৯৭৩৯৬
Email : meahmonsaf@gmail.co
wavesite : www.bskmelabd.org

 

   


পাঠকের মন্তব্য