অবহেলিত বেরোবির স্বাধীনতা স্বারক 

অবহেলিত বেরোবির স্বাধীনতা স্বারক 

অবহেলিত বেরোবির স্বাধীনতা স্বারক 

১৯৭১ এর ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি দীর্ঘ নয় মাস পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অর্জন করে তাদের অধিকার ছিনিয়ে নেয় বিজয়। এই যুদ্ধে দেশকে রক্ষা করতে মৃত্যু বরণ করেন লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা।

দেশের এই অর্জনে যে বীরেরা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের স্মৃতি ও বীরত্বের কথা বাংলার বুকে ধারণ করতে ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের বিভিন্ন মাধ্যমের পাশাপাশি তৈরি করা হয় বিভিন্ন ভাস্কর্য।বাংলার বুকে বাংলার বীরদের গৌরবময় ইতিহাস ফুটিয়ে তোলার নিমিত্তেই উত্তরবঙ্গের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১২ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয় স্বাধীনতা স্বারকের। শিক্ষার্থী ও জনগণের মাঝে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান, মুক্তচিন্তার বিকাশ সাধনের লক্ষ্যেই এই প্রকল্প গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।তবে কাজ শেষ হওয়ার আগেই কয়েকধাপে বন্ধ হয়ে যায় কাজটি।বছরের পর বছর শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষ হলেও শেষ হয়না স্বাধীনতা স্বারকের কাজ।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মূল ফটক দিয়ে ঢুকে হাতের বাম পাশে তাকাতেই চোখে ধরা পড়ে কংকালের ন্যায় জরাজীর্ণ ও শ্রীহীন স্বাধীনতা স্বারক। কাজ শুরুর প্রায় একযুগ হলেও নির্মাণকাজ শেষ হয়নি এই স্থাপনাটির। তবুও ভ্রুক্ষেপ নেই প্রশাসনের,অসম্পূর্ণ এই স্বাধীনতা স্বারকের খোঁজ নেয়া হয় শুধু মাত্র বিভিন্ন দিবসে ফুল ও শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়ার সময়ে। নানা অব্যবস্থাপনা ও অবহেলায় স্বাধীনতা স্বারক চত্ত্বর যেন হয়ে উঠেছে বহিরাগতদের আনাগোনার স্থল,মাদক গ্রহণের নির্ভরযোগ্য স্থান ও অসামাজিক কাজের আতুরঘরে।

২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতা স্বারকের ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য দ্বিতীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মু. আবদুল জলিল মিয়াকে অনুদান প্রদান করে জনতা ব্যাংক।পরের বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন অধ্যাপক ড. এ. কে .এম নুরুন্নবী এবং তিনি স্থাপনাটির নির্মাণ কাজ শুরুর লক্ষ্যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ঐ বছরের ২৮ নভেম্বর। কিছুদিন কাজ চলার পরে নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ উপাচার্য হিসেবে ২০১৭ সালে যোগদান করেন অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ এবং তিনিই সে বছর পুনরায় স্বাধীনতা স্বারকের নির্মাণকাজ শুরু করেন। তবে সেসময়েও কাজ শেষ না হওয়ার আগেই আবার বন্ধ হয়ে যায় নির্মাণকাজ। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ ২০২১ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করলেও স্বাধীনতা স্বারকের নির্মাণকাজ পুনরায় শুরুর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের দক্ষিণে, অস্থায়ী শহীদ মিনারের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অসম্পূর্ণ স্বাধীনতা স্বারকটি।প্রকৌশল সূত্রে জানা যায়,স্থাপনাটির মূল স্তম্ভ থাকবে তিনটি। যার মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘটির উচ্চতা ৫৫ ফুট।পরের দুটির উচ্চতা হবে ৩৫ ও ২৫ ফুট করে এবং এসব স্তম্ভ নির্মিত হবে ১১ হাজার ৬৯৬ বর্গফুট আয়তনের বেদির উপর। মার্বেল পাথর দিয়ে মেঝে নির্মিত হবে এবং স্তম্ভের গায়ে থাকবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ও পোড়ামাটির শিল্পকর্ম এবং পাশের দেয়ালগুলোয় থাকবে টাইলস দিয়ে নির্মিত বিভিন্ন জনের প্রতিকৃতি বা ম্যুরাল।

তবে বর্তমানে স্থাপনাটির নির্মাণকাজে তিনটি স্তম্ভ দাঁড় করানোসহ কিছু কাজ হলেও করা হয়নি স্তম্ভের গায়ের পোড়ামাটির কারুকার্য শোভিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিসহ অন্যান্য শিল্পকর্ম,মেঝেতে বসানো হয়নি মার্বেল পাথর,দেয়ালে নির্মিত হয়নি টাইলস দিয়ে নির্মিত প্রতিকৃতি।এছাড়াও স্থাপনাটির দুপাশে মাটি দিয়ে ভরাট কাজও হয়নি।তাছাড়া স্তম্ভগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় যত্নের অভাবে গায়ে শ্যাওলা পরে বর্ণহীন ও বিশ্রী হয়ে আছে।দেখলে যেন মনে হয় স্বাধীনতা স্বারক নয় বরং এর দৈত্যাকার কংকাল দাঁড়িয়ে আছে মাঠের মাঝে।

প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় এবং অযত্নে পড়ে থাকার ফলে সেখানে দিনদিন বাড়ছে বিভিন্ন অসামাজিক কার্যক্রম।সন্ধ্যা পেরোলেই সেখানে চলে মাদকসেবনের মেলা।তাছাড়া বিকেলে গড়ালেই সেখানে টোকাই ও বহিরাগতদের আড্ডাখানায় রুপ নেয় স্থানটি যার ফলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।এমন অযত্ন,অব্যবস্থাপনার ফলেই দিনদিন মর্যাদা হারাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্থাপনাটি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা স্বারকটির এমন হালের পেছনে প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের অবহেলা ও নজরদারিতার অভাব রয়েছে। প্রথমে জনতা ব্যাংক স্বাধীনতা স্বারক নির্মাণের জন্য ২০ লক্ষ টাকার অনুদান প্রদান করে।২০১৩ তে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর কাজ কিছুদিন চললেও পরবর্তীতে টাকা সংকট দেখিয়ে কাজ বন্ধ হয়ে যায়।কিন্তু পরবর্তী আবার প্রায় ১ কোটি ৬ লক্ষ টাকা বাজেট পেয়ে পুনরায় কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে এবং স্তম্ভ গুলো নির্মাণ ও চারপাশে বেদি নির্মাণ হলেও মার্বেল পাথরের কাজ ও পোড়ামাটির কারুকার্য শোভিত কাজ এবং দেয়ালে প্রতিকৃতি নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার আগেই সেখানেও প্রশাসনের অবহেলায় কাজ বন্ধ হয় পুনরায়। তাছাড়া দূর্নীতির অভিযোগও পাওয়া গেছে বেশ কয়েকবার যার ফলে কাজটি তখনও সম্পন্ন হতে পারেনি। পরবর্তীতে প্রায় ৪ বছর থেকে বন্ধ হয়ে রয়েছে এই ভাস্কর্য নির্মাণের কাজটি।

প্রতিবছর জাতীয় বিভিন্ন দিবসে সংশ্লিষ্টদের পা পড়ে এবং সেই দিন উপলক্ষেই প্রশাসনের দৃষ্টি পড়ে স্বাধীনতা স্বারকের দিকে।এবং শুধু মাত্র ফুল ও শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের মধ্যদিয়ে এবং নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ হবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েই শেষ করেন দায়িত্ব।

তবে একযুগ পরেও শিক্ষার্থীদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য স্থাপনা স্বাধীনতা স্মারক যা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় এককভাবে তুলে ধরে সেই ভাস্কর্যের কাজ অতিদ্রুত শেষ হয়ে যাক।বিশ্ববিদ্যালয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকুক স্বাধীনতা স্বারক,প্রকাশ করতে থাকুক বাংলার গৌরবময় ইতিহাসের কথা।

   


পাঠকের মন্তব্য