এবি ব্যাংকের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ

কলামিস্ট মিয়া মনসফ

কলামিস্ট মিয়া মনসফ

মিয়া মনসফ : গত বছর বৈশ্বিক খাদ্য ঘাটতির সম্ভাবনার কথা জানিয়ে বিশ্বকে সতর্ক বার্তা দিয়েছিল জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। গত বছর মে মাসে এফএও এর প্রধান বিশ্লেষক লুকা রুশো বলেন, ‘‘ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী তীব্র সংকটের সম্ভাবনা রয়েছে।” 

বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে এই সংকট সবচেয়ে বেশি হতে এমন শংকার কথাই জানান তিনি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই খাদ্য সংকট মোকাবেলায় দেশবাসীকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘‘আমরা যদি খাদ্য সংকট মোকাবেলায় এখন থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করি এদেশের খাদ্য সংকট হবেনা।” মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেকোন দুর্যোগ মোকাবেলায় বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে থাকেন। বর্তমান বৈশ্বিক খাদ্য সংকট মোকাবেলায় তিনি দেশের মানুষকে আহবান জানিয়েছেন, যাতে এক ইঞ্চি জায়গাও অনাবাদি পড়ে না থাকে।

সরকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে নানামুখি কর্মসূচি গ্রহন করেছে। নেয়া হয়েছে কৃষকের উন্নয়নে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। 

এই কর্মসূচির আওতায় কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও ঋণ বিতরণ করা হবে। এর সুফল পাবে ১ কোটি ৮০ লক্ষ কৃষক। ডিজিটাল কৃষি পরিষেবার আওতায় দেওয়া হবে স্মার্ট কার্ডও। এই প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ হাজার ২শত কোটি টাকা। এর বাস্তবায়ন শুরু হবে আগামী বছর থেকে।  

ডাটাবেজ তৈরি করে কৃষকদের দেওয়া হবে স্মার্ট কার্ড। এর মাধ্যমে কৃষকরা প্রণোদনা, কৃষি উপকরণে ভর্তুকি ও ঋণ সহায়তা পাবে। কৃষকরা এসব সুযোগ সুবিধা পেলে কৃষি উৎপাদন বাড়বে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণও সম্ভব হবে।  

আমাদের দেশের শতকরা ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজের সাথে জড়িত। জিডিপির ১৩ শতাংশেরও বেশি কৃষি খাত থেকে আসে। সবচেয়ে বড় কথা মোট জনসংখ্যার বেশিরভাগ মানুষ কৃষি খাতে জড়িত। কিন্তু যদি তারা কৃষি উৎপাদনে সহযোগিতা না পায় ! কৃষিকাজ করে তারা লাভবান না হয়! কৃষির প্রতি তাদের আগ্রহ কমে যাওয়াই স্বাভাবিক। ফলে কৃষি উৎপাদন কমে যাবে। দেশে  খাদ্য ঘাটতি হবে। খাদ্য নিরাপত্তা ভেঙ্গে পড়বে। এ কারণে সরকার কৃষি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে বর্তমান বিশ্বমন্দা পরিস্থিতিতে। খাদ্য নিরাপত্তা মোকাবেলা কি শুধু সরকারের দায়িত্ব ? বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশের খাদ্যের চাহিদা পূরণে একটি সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। যেখানে সরকারী বেসরকারী সহ সংশ্লিষ্ঠ সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। এখানে সরকার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করবে। উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে স্ব উদ্যোগে বিশ্বমন্দার এই সংকট মোকাবেলায় এগিয়ে আসতে হবে। 
 
বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ‘‘এবি ব্যাংক” ইতিমধ্যে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের সহযোগিতা করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি এগিয়ে এসেছে। ‘এবি ব্যাংক স্মার্ট কৃষি ঋণ’ বিতরণ শুরু করেছে। স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের মাঝে এই ঋণ বিতরণ করছে তারা। গত দু’মাসে কয়েকটি জেলায় প্রান্তিক পর্যায়ের প্রায় ৮ হাজার কৃষককে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে কৃষি ঋণ দিয়েছেন। আগামীতে পর্যায়ক্রমে তাদের ঋণ বিতরণ কার্যক্রমের পরিধি বাড়াবেন।  এবি ব্যাংকের এই কর্মসূচির প্রধান পরিকল্পনাকারী ব্যাংকের সভাপতি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আফজাল। 

এই কর্মসূচির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে’ একথা আমরা বিশ্বাস করি; তাই প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষককে সহযোগিতা করতে আমাদের এই উদ্যোগ। তিনি আরো বলেন, মাত্র ৪ শতাংশ সুদে প্রান্তিক কৃষক প্রাপ্তঋণের অর্থ কৃষি কাজে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে লাভবান হবে, সেই সাথে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে উদ্যোগ নিয়েছেন সেই উদ্যোগে সামিল হতে এবি ব্যাংকের পক্ষ থেকে স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। 

এবি ব্যাংকের এই উদ্যোগ প্রশংসা পাবার দাবী রাখে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেশের খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। বাংলাদেশে অর্ধশতাধিক বেসরকারী ব্যাংক আছে তারাও এগিয়ে আসতে পারে। বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের নামে যারা ব্যাংক থেকে শত হাজার কোটি ঋণ নিয়ে, ঋণ সুদাসলে ফেরত দেবার কথা তো দূরে থাক্, ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করে দেশান্তরী হয়েছে, জেলের বাসিন্দা হয়েছে ঋণগ্রহীতারা। কিন্ত আমাদের এই সহজ সরল কৃষকরা ঋণ নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাবার কথা ভাবতেই পারেনা। যে কৃষক নিজে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে এনজিও থেকে সামান্য ঋণ নিয়ে কৃষি উৎপাদনের চেষ্টা করে, ঋণের টাকা দিতে না পেরে আত্মহত্যার ঘটনাও আছে এদেশে। অথচ এই কৃষকরাই তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাদ্যোৎপাদন করে যাচ্ছে দেশের মানুষের জন্য। খাদ্য নিরাপত্তায় তাদের ভূমিকার কথা বলতেও যেন আমরা ভুলে যাই! অথচ আমাদের কৃষি জিডিপিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে। আমাদের উন্নয়নের সবচেয়ে চালিকা শক্তি কৃষক ও কৃষি। সরকারের পাশাপাশি সকল সংস্থা যদি এগিয়ে আসে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবেই। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। বিশ^ যতই মন্দার মধ্যে যাক না কেন, সেই মন্দা স্পর্শ করবেনা এদেশের মানুষকে।  

বিশ্ব খাদ্য সংস্থা যে খাদ্য সংকটের  হুঁশিয়ারি দিয়েছে তার কারণ ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন এই অসম যুদ্ধ শুরু হয় তখনই আশংঙ্কা করা হয়েছিল, বিশ্বখাদ্য সংকটের দিকে যাচ্ছে। তার কারণ হলো বিশ্বের উৎপাদিত খাদ্যের একটি বড় অংশ এই দুই দেশে উৎপাদন হয়। যুদ্ধ বেঁধে গেলে এই দুই দেশ থেকে খাদ্য রপ্তানি কমতে থাকে। 
 
দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের নানামুখি উদ্যোগ নেয়ার ফলে দারিদ্র্যতা কমেছে। ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক তিন শতাংশ। সেই হার ২০২২ সালে কমে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। বর্তমান সরকার গ্রামীন জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে আয়ের পথ করে দেয়ার নানামূখি কর্মসূচি।  

এদেশ যখন স্বাধীনতা অর্জন করে তখন দেশের জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি। অর্ধশত বছরে সেই জনসংখ্যা এখন ষোল কোটি। কিন্তু আমাদের জমি তো বাড়েনি! দিন দিন খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। তা হলে সেই খাদ্য কোত্থেকে আসবে সেই গবেষণা করার সময় এসেছে। আমাদের  উৎপাদন বাড়াতে হবে। আর সেই উৎপাদন হবে মাটিকে ব্যবহার করে। অঞ্চল ভেদে মাটির পরীক্ষা করে কৃষি উৎপাদন করতে হবে। নারী পুরুষকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপযোগী করে তুলতে হবে। 

আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব। উন্নত মানের বীজ উৎপাদন, মাছ চাষ, হাঁস মুরগী, গবাদি পশু পালন, কৃষি কাজে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার, সারের মূল্য হ্রাসসহ কৃষি উৎপাদনে সকল উপকরণ প্রাপ্তি সুনিশ্চিত করা গেলে খাদ্য উৎপাদন বাড়বে।  খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এজন্য বেসরকারী কোম্পানীগুলেকে সুযোগ সুবিধা দিয়ে বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

যে সময় আমার এই লেখা লিখছি, তখনই আইএমএফ এক দুঃসংবাদ দিচ্ছে, ওয়াসিংটনে আইএমএফ ও বিশ^ব্যাংকের বসন্তকালিন বৈঠকে তাদের প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে, চলতি বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশে নেমে যেতে পারে। যদিও সরকার চলতি অর্থ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সাড়ে ৭ শতাংশ। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক শংকা নিয়ে আগেও আইএমএফ এরকম মন্তব্য করেছে! এ বিষয়ে সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপে সকল সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। 

বাঙ্গালি বীরের জাতি। একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ গঠনে জাতি ঝাঁপিয়ে পড়লো বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পরও দেশে স্থিতিশীলতা আসেনি। আবার আরেক অপশক্তির জন্ম নেয় দেশে। দেশ জুড়ে সর্বহারার উত্থানে দেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠে। ১৯৭৪ সালে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে।  যে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও তারা অন্তরে বাংলাদেশকে দেখে বাঁকা চোখে। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিল। এমন কি খাদ্য নিয়ে বাংলাদেশে আসার পথে জাহাজ ফিরিয়ে নিয়েছিল কিউবার কাছে বাংলাদেশ পাট বিক্রির অপরাধে। 

সেই রকম পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বাংলাদেশ আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। কোন্ প্রভূ দেশ বা কোন্ সংস্থা কি মন্তব্য করলো তাতে আমাদের গায়ে মাখার সুযোগ নেই। এসব নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মোটেই চিন্তিত নন। করোনা ও ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে অনেক দেশ মন্দাভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেখানে শেখ হাসিনা সরকার তৃণমূল মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবীদের যাতে কোন সমস্যা না হয় সেজন্য নগদ অর্থসহ বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে ব্যবসা বানিজ্য, কৃষি, শিল্পসহ অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রাখেন। 

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের কলেবর বৃদ্ধি করা হয়েছে। অতি উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ ক্রয় করেও জনগনের মাঝে বিতরণ করছেন। দেশের অনাবাদি প্রতি ইঞ্চি জায়গা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে যদি আবাদের আওতায় আনা যায়, তাহলে এদেশের খাদ্য নিরাপত্তা আরো নিশ্চিত হবে।

লেখক : কলামিস্ট 

পাঠকের মন্তব্য