সিজারের পর পেটে গজ, ক্লিপ রেখে সেলাই; রোগীর মৃত্যু

 সুমি প্রাইভেট ক্লিনিক এন্ড নার্সিং হোম

সুমি প্রাইভেট ক্লিনিক এন্ড নার্সিং হোম

সিজারের পর প্রসূতির পেটে গজ কাপড়, টিস্যু ও ক্লিপ রেখে সেলাই, সেই সেলাইটাও ঢিলেঢালা। যেন সবকিছুই দায়সাড়া। এমন ঘটনায় পেটে রক্ত জমাট বেধে পঁচে দুর্গন্ধ হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ঘটনার ১১দিন পরে ঐ প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হয়েছে। এমনই অভিযোগ উঠেছে, ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলা সদরের সুমি প্রাইভেট ক্লিনিক এন্ড নার্সিং হোমের বিরুদ্ধে। ঘটনাটি আড়াল করার জন্য মৃত প্রসূতির স্বজনদের মিমাংসার প্রস্তাব দিয়েছে ঐ ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ।

জানা যায়, গত ১৩ই এপ্রিল পেটে ব্যাথা নিয়ে সুমি ক্লিনিকে ডাক্তার দেখাতে যান উপজেলার বাগাট ইউনিয়নের মিটাইন গ্রামের মনিরুল ইসলামের স্ত্রী রত্না বেগম। এক পর্যায়ে তাকে সিজার করার পরামর্শ দেন ঐ ক্লিনিকের স্বত্ত্বাধিকারী সুমি আক্তার। পরে ঐদিন রাতেই তার অপারেশন করেন মাগুরা থেকে আসা ডাক্তার মাসুদুল হক। ঘটনার ১০দিন পরে ২৩ এপ্রিল প্রসূতি মায়ের ব্লিডিং শুরু হলে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করেন স্বজনরা। ঐদিনই প্রসূতিকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার্ড করেন কর্তব্যরত ডাক্তার। এরপর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ও পেটে ইনফেকশনে ২৪শে এপ্রিল  মৃত্যু হয় ঐ প্রসূতি মায়ের।

মৃত রত্না বেগমের স্বামী মোঃ মনিরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ১৩ ই এপ্রিল সুমি ক্লিনিকে আমার স্ত্রীর সিজার করানো হয়। তখন আমার পুত্র সন্তান হয়। এরপরই বাচ্চা অসুস্থ হওয়ায় ফরিদপুর শিশু হাসপাতালে নেয়া হয়। এরপর তারা সেলাই করে বেডে পাঠিয়ে দেন। পরবর্তীতে কয়েকদিন পরে আমার স্ত্রীর প্রচুর ব্লিডিং শুরু হয়। তখন ফরিদপুর মেডিকেলে নিলে ডাক্তার দেখে বলে, সিজারের পরে যে সেলাই করা হয়েছে তার মাঝে ফাঁকা রয়েছে, সুতো মিলে নাই, ভেতরে রক্ত জমাট বেঁধে পচে গেছে। এরপর ডাক্তারের পরামর্শে রোগীকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। সেখানকার ডাক্তার জানায়, যতক্ষণ ব্লাড দেয়া হবে, ততক্ষনই রোগী বাঁচবে। আমি তখন ডাক্তারের কাছে সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আমাকে বলেন, এই রোগীর যে সিজার করেছে সে ডাক্তার নাকি কসাই? সেলাই ভালো হয়নি, ফুটো রয়েছে। এরপর আল্ট্রাসনোগ্রাম করে অপারেশন করা হলে দেখা যায়, ভেতরে তুলো, গজ কাপড় ও একটা ক্লিপ রয়েছে। এছাড়া বাচ্চার নাড়িও সঠিকভাবে কাটা হয়নি, ভেতরে রয়ে গেছে। যেকারনে, পেটের ভেতর পচে দুর্গন্ধ হয়ে ইনফেকশন হয়ে মারা গেছে।

এ সময় প্রসূতি রত্নার মা বলেন, আমার মেয়ের পেটে ব্যাথা উঠলে ডাক্তার দেখাতে যাই। তখন সুমি ক্লিনিকের সুমি আক্তার সিজার করাতে বলে। আমরা চলে আসতে গেলে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমাদের এখানে ভালো ডাক্তার রয়েছে, আপনার মেয়ের সমস্যা হবে না। এখন কি করলো ওরা, আমি ওদের বিচার চাই।

এ সময় স্থানীয়রা সুমি ক্লিনিক বন্ধ ও জড়িতদের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়ে বলেন, এটা হত্যাকান্ড। আমরা সুমি ক্লিনিকের সর্বোচ্চ বিচারের দাবি জানাই। তারা আরো বলেন, সুমি ক্লিনিকতো ক্লিনিক নয়, একটা কসাইখানা। রোগী গেলে তারা ছাড়ে না। জোড় করে রেখে দেয়। এর আগেও এরকম কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালের স্বত্ত্বাধিকারী সুমি নামের মেয়েটি উন্নত চিকিৎসার জন্য বাঁধা দিয়েছে। সিজারের আগে জানানো হয়েছিলো, এখানে সিজার করবো না কিন্তু গ্রামের মানুষ পেয়ে ভুল বুঝিয়ে সিজার করে।

এদিকে রত্না বেগমের সিজারের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ডাঃ মাসুদুল হক। তিনি জানিয়েছেন, গত দেড় বছর যাবৎ মধুখালীতে যাওয়া হয়না, আমি কিভাবে সিজার করবো। তবে, ঐ ক্লিনিকের স্বত্ত্বাধিকারী সুমি আক্তারের দাবি ডাঃ মাসুদুল হক সিজার করেছেন কিন্তু তার কোনো স্বাক্ষর রাখা হয়নি। সুমি আক্তার আরও জানান, ডাঃ মাসুদুল হক ও ডাঃ সালাম এখানে যে অপারেশন করেন তার কোন প্রমান আমরা রাখতে পারিনা। তাদেরকে সই করতে বললে তারা বলে পরে করবো। 

বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) দুপুরে সরেজমিনে গেলে ডাঃ মাসুদকে না পাওয়া গেলে মুঠোফোনে কথা হলে বিষয়টি উঠে আসে। 

এ সময় এ প্রতিবেকদের সাথে সংবাদ সংক্রান্ত বক্তব্য দিতে অস্বীকার করেন স্বত্ত্বাধিকারী সুমি আক্তার। তিনি অপর স্বত্ত্বাধিকারী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ মুরাদুজ্জামান (মুরাদ) এর সাথে কথা বলতে বলেন এবং তাৎক্ষনিক ডেকে আনেন। এ সময় মুরাদুজ্জামান বলেন, আপাতত বক্তব্যর প্রয়োজন নেই। আমরা রোগীর স্বজনদের সাথে মিমাংসার কথা বলেছি।

এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ আঃ সালাম বলেন, বিষয়টি নিয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে সরেজমিনে উঠে আসে সুমি ক্লিনিকের বিভিন্ন অনিয়ম। ১০ শয্যা বিশিষ্ট এই ক্লিনিকটিতে মাত্র একজন ডিপ্লোমাধারী নার্স রয়েছে, এমনকি নেই কোনো আবাসিক ডাক্তার। ২৭ এপ্রিল পাঁচজন রোগী ক্লিনিকটিতে ভর্তি থাকলেও ছিলো না কোন ডাক্তার বা নার্স।  ভ্রাম্যমাণ ডাক্তার দিয়েই করানো হয় সিজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন।

   


পাঠকের মন্তব্য