স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচন; জয় পরাজয়  

স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত সরকার গঠন; জয় পরাজয়  

স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত সরকার গঠন; জয় পরাজয়  

স্বাধীনতার পর একাদশ সংসদ নির্বাচনসহ মোট ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। স্বাধীন বাংলাদেশের ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঘুরে ফিরে তিনটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে। এরইমধ্যে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি চারবার করে ক্ষমতায় আসলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ পঞ্চমবারের মত সরকার গঠন করে। এ নিয়ে দেশের পুরনো দলটির জন্য এটি একটি নতুন রেকর্ড। এর আগে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল চারবার করে সরকার গঠন করে রেকর্ডের সমান ভাগিদার ছিল। নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

আওয়ামী লীগের পঞ্চমবার সরকার গঠন : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিজয়ের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ পাঁচবার ও বিএনপি চারবার এবং জাতীয় পার্টি দুইবার বিজয়ী হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামীলীগ প্রথম, সপ্তম, নবম,. দশম ও এগারতম সংসদে এবং বিএনপি দ্বিতীয়, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও অষ্টম সংসদে জয় পায়। 

অন্যদিকে, জাতীয় পার্টি তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়। এর আগে আওয়ামীলীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি টানা দুইবার করে সরকার গঠন করলেও কোন দল টানা তিনবার সরকার গঠন করতে পারেনি। এবার আওয়ামীলীগ টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করে।

পাঁচটি সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি : বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। সর্বশেষ দশম সংসদ নির্বাচন হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। প্রতিটি সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর হলেও ১০টি সংসদের মধ্যে ৫টি সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে ৫টি সংসদ মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। মেয়াদ শেষ করতে না পারা সংসদের মধ্যে রয়েছে, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ এবং ষষ্ঠ সংসদ। তবে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম সংসদ তার মেয়াদকাল পূরণ করতে পেরেছে।

কোন নির্বাচনে কত ভোট পড়েছে : বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম সংসদ নির্বাচনে। এই নির্বাচনে ৮৭ শতাংশ ভোট পড়ে। অন্যদিকে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে। এতে ভোট পড়ে ২৬.৫ শতাংশ। এছাড়াও, প্রথম সংসদ ৫৪.৯ শতাংশ, দ্বিতীয় সংসদ ৫১.৩ শতাংশ, তৃতীয় সংসদ ৬১.৩ শতাংশ, চতুর্থ সংসদ ৫২.৫ শতাংশ, পঞ্চম সংসদ ৫৫.৪ শতাংশ। অন্যদিকে, সপ্তম সংসদে ৭৫.৪৯ শতাংশ, অষ্টম সংসদে ৭৫ শতাংশ এবং দশম সংসদে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। তবে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের কত শতাংশ ভোট পড়েছে তা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়নি। তবে, এবার ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে বলে জানা গেছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ৩৯টি নিবন্ধিত দলের সব কয়টি দল অংশ গ্রহণ করে। নির্বাচনে মোট প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৮৬১ জন। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ১ হাজার ৭৩৩ জন এবং ১২৮ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে অংশ নেয়। ৩০০ আসনের মধ্যে ১টি আসনের প্রার্থী মারা যাওয়ায় ২৯৯টি আসনে নির্বাচন হয়। ১টি আসনের ফলাফল স্থগিত থাকায় বাকি ২৯৮টি আসনের মধ্যে আওয়ামীলীগ নৌকা প্রতীকে এককভাবে ২৫৯টি আসনে জয়লাভ করে। এছাড়াও জাতীয় পার্টি লাঙ্গল প্রতীকে ২০টি, বিএনপি ধানের শীষ প্রতীকে ৫টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ২টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ ২টি এবং জাতীয় পার্টি (জেপি)১টি, তরিকত ফেডারেশন ১টি , গণফোরাম ২টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে, ৩টি আসনে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন: ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বাকি ১৪৭টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামীলীগ মোট ২৩৪টি, জাতীয় পার্টি ৩৪টি, ওয়াকার্স পার্টি ৬টি, জাসদ ৫টি, জাতীয় পার্টি (জেপি) ২টি, তরিকত ফেডারেশন ২টি, বিএনএফ ১টি, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৬টি আসনে জয়লাভ করেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এই নির্বাচন বর্জন করে।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন: ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সংসদে আওয়ামীলীগ ২৩০টি আসনে জয়লাভ করে। এই নির্বাচনে বিএনপি ৩০টি, জাতীয় পার্টি ২৭টি, জাসদ ৩টি, জামায়াত ইসলামী ২টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ২টি, বিজেপি ১, এলডিপি ১টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৪টি আসনে জয়লাভ করে।

অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন:  ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচেন বিএনপি ১৯৩টি আসনে জয়লাভ করে। এছাড়াও, আওয়ামীলীগ ৬২টি, জাতীয় পার্টি ১৪টি, জামায়াত ইসলামী ১৭টি, বিজেপি ৪, জেপি (মঞ্জু) ১টি, ইসলামী ঐক্যজোট ২টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ১টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬টি আসনে বিজয়ী হয়।

সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ১৪৬টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। এছাড়াও নির্বাচনে বিএনপি ১১৬টি, জাতীয় পার্টি ৩২টি, জামায়াত ইসলামী ৩টি, ইসলামী ঐক্যজোট ১টি, জাসদ ১টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ১টি আসনে বিজয়ী হয়।

ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে অধিকাংশ দল নির্বাচন বর্জন করেছিল। নির্বাচনে খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বিএনপি ২৭৮টি আসন লাভ করেছিল। এছাড়া ফ্রিডম পার্টি ১টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১০টি আসল লাভ করেছিল। এর বাইরে ১০টি আসনের ফলাফল অসমাপ্ত থাকে এবং আদালতের রায়ে একটি আসনের নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছিল।

উল্লেখ্য, ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ কারচুপী হয়েছিল বলে দাবি করেছিল। এই সময় বিরোধী দলগুলো নিরপেক্ষ তত্ত্ববধায়ক সরকারে অধীনে নির্বাচনের দাবি তোলে। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম জামায়েত-ই-ইসলামী এবং তারপর আওয়ামী লীগ সংসদ সচিবালয়ে পরবর্তী নির্বাচনগুলোকে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পেশ করে। অবশ্য তৎকালীন খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার এই দাবি মেনে নেয় নি। এই সময় কমনওয়েলথ ও অন্যান্য সংস্থা সরকার ও বিরোধীদলগুলোর সাথে সমঝোতার চেষ্ঠা করে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সহিংস ঘটনার মধ্যে এবং বিরোধীদলগুলোর প্রবল প্রতিবাদ ও নির্বাচন বর্জনের পরও ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

এই নির্বাচনে মোট ভোটদাদাতার সংখ্যা ছিল ৫,৬১,৪৯,১৮২ জন। এর ভিতরে পুরুষ ভোটার ছিল ২,৩৭,৬৫,৭৫২ এবং নারী ভোটার ছিল ২,৩২,৩৮,২০৪ জন। তবে ভোট সংগ্রহের হার ছিল মাত্র ২৬.৫৪%।

পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন: ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। এতে বিএনপি ১৪০টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। এছাড়াও আওয়ামী লীগ ৮৮টি, জাতীয় পার্টি ৩৫টি, বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী ১৮টি, সিপিবি ৫টি, বাকশাল ৫টি, জাসদ (সিরাজ) ১টি, ইসলামী ঐক্যজোট ১টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ১টি, এনডিপি ১টি, গণতন্ত্রী পার্টি ১টি, ন্যাপ (মোজাফফর) ১টি, অনান্য দল ৩টি আসনে জয়লাভ করে।

চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৫১টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে আ স ম আব্দুর রব এর নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বিরোধী দল ১৯টি, জাসদ (সিরাজ) ৩টি, ফ্রিডম পার্টি ২টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ২৫টি আসনে বিজয়ী হন। এই নির্বাচনে আওয়ামীলীগ, বিএনপি, সিপিবিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বর্জন করে।

তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসনে বিজয়ী হয়। এছাড়াও আওয়ামীলীগ ৭৬টি জামায়াত ইসলামী ১০টি, সিপিবি ৫টি, ন্যাপ (মোজাফফর) ২টি, ন্যাপ ৫টি, বাকশাল ৩টি, জাসদ (রব) ৪টি, জাসদ (সিরাজ) ৩টি, মুসলিম লীগ ৪টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩২টি আসনে জয়লাভ করেন। বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এই নির্বাচন বর্জন করে।

দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জিয়াউল রহমানের আমলে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিএনপি ২০৭টি আসনে জয়লাভ করে। এই নির্বাচনে আওয়ামীলীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে অংশগ্রহণ করে। এরমধ্যে আওয়ামীলীগ (মালেক) ৩৯টি, আওয়ামীলীগ (মিজান) ২টি, জাসদ ৮টি, মুসলিমলীগ ও ডেমোক্রেটিক লীগ ২০টি, ন্যাপ (মোজাফফর) ১টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ২টি, বাংলাদেশ গণফ্রন্ট ২টি, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল ১টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ১টি, জাতীয় একদা পার্টি ১টি এবং ১৬টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করেন।

প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন : বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ নৌকা প্রতীক নিয়ে ২৯৩টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। এছাড়াও জাসদ ১টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ১টি এবং ৫টি আসন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। প্রথম সংসদে ১১ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হন।

   


পাঠকের মন্তব্য