দীর্ঘ ৭১ বছরেও ভাষা সৈনিকের স্বীকৃতি পায়নি শহীদ এমএ গফুর

অন্যতম সংগঠক ভাষা সৈনিক শহীদ এমএ গফুর
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বায়ান্ন বছরের আর মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের ৭১ বছরের দীর্ঘ সময়ে পার হলেও ভাষা সৈনিকের স্বীকৃতি মেলেনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ভাষা সৈনিক শহীদ এমএ গফুরের।
অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার পরও এখনো পর্যন্ত মেলেনি স্বাধীনতা পদক। দেরিতে হলেও বর্তমান সরকারের সময়েই বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন শহীদ এম এ গফুর ভাষা সৈনিকের স্বীকৃতি এবং স্বাধীনতা পদক পাবেন এমনটাই প্রত্যাশা করেছেন শহীদ এমএ গফুরের পরিবার ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত এলাকাবাসী। ৬ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সহচর, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভাষা সৈনিক ও সাবেক এমএনএ শহীদ এমএ গফুরের ৪৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী।
খুলনার ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী এমএ গফুর বাংলা ১৩৩২ বঙ্গাব্দে ২৬ বৈশাখ খুলনার (বর্তমান) কয়রা উপজেলার হরিনগর গ্রামের এক সম্ভান্ত্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৃত জনাব আলী সানা, মাতা সোনাবান বিবি। কর্মময় জীবনে তিনি যেমন ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছের মানুষ, তেমনি ছিলেন সাধারণ মানুষের কাছে একজন আলোকিত ব্যক্তি। শহীদ এম এ গফুর ৪ ভাই ও দু’বোনের মধ্যে ছিলেন পঞ্চম। তিনি কপিলমুনি স্কুল থেকে প্রাইমারী শেষ করে পার্শ্ববর্তী আশাশুনির বুধহাটা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হন খুলনার ঐতিহ্যবাহি বিএল কলেজে। ছাত্র জীবনে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন (ন্যাপ) রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এইচএসসি পাশ করার পর বিএ পড়াকালীন শুরু হয় ৫২ এর ভাষা আন্দোলন।
২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকার রাজপথে রক্তঝরার খবরটি খুলনায় পৌঁছায় পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারী, আর তখনই রাজপথে নেমে আসে খুলনার ছাত্রসমাজ। এদিন সমীর আহম্মেদের নেতৃত্বে নগরীর আহসান আহম্মেদ রোডের এ কে শামসুদ্দিন আহমেদ শুনুর আজাদ গ্রন্থাগারে প্রথম বৈঠক করেন খুলনার ছাত্রসমাজ। বৈঠকে এমএ গফুরসহ উপস্থিত ছিলেন আবু মোহাম্মদ ফেরদৌস, এমএ বারী, নূরুল ইসলাম দাদু, এসএম জলিল, জাহিদুল হক ও তোফাজ্জেল হোসেনসহ অনেকেই। বৈঠকে উপস্থিত সকলেই কঠোর আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেন।
গণতন্ত্রী দলের খুলনা জেলা সম্পাদক ভারত বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান ভাষা সংগ্রাম কমিটির খুলনা জেলা আহ্বায়ক ছিলেন। এমএ গফুর এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তখনকার মুসলিমলীগের গুন্ডা ও পুলিশের বাঁধা উপেক্ষা করে গফুরসহ তার সহকর্মীরা পায়ে হেঁটে নগরীর স্কুল, কলেজগুলোতে গিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে ভাষা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন। পুলিশের হয়রাণীর শিকার ও মিথ্যা মামলায় জেলও খাটেন আন্দোলনের অনেকেই। এম এ গফুর বিএল কলেজ থেকে বিএ পাশ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে যোগদান করার মাধ্যমে ১৯৬৯ সালে ঝাঁপিয়ে পড়েন গণঅভ্যূত্থান আন্দোলনে। ধীরে ধীরে তিনি আস্থা এবং বিশ্বাস অর্জন করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি পাইকগাছা-কয়রা ও আশাশুনি এলাকা থেকে এমএনএ নির্বাচিত হন।
এরপর তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধকালীন তিনি ৯নং সেক্টরে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ ৯ মাসের স্বসস্ত্র সংগ্রামে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে আসার পর এমএ গফুরের অনুরোধে ওয়াপদা ভেঁড়িবাঁধ নির্মাণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২২ ফেব্রুয়ারী সফর করেন খুলনার পাইকগাছা উপজেলার লস্কর ইউনিয়ানের আলমতলা এলাকায়। ভেঁড়িবাঁধ নির্মাণসহ অন্যান্য সামাজিক উন্নয়ন কাজ ও সহজ সরল জীবন যাপনে সাধারণ মানুষের কাছে অতিসহজে এমএ গফুর হয়ে ওঠেন জনপ্রিয় ও একজন আলোকিত ব্যক্তি। তার জনপ্রিয়তায় ঈর্শান্বিত হয়ে ওঠেন স্বার্থন্বেষী একটি কুচক্রী মহল। ১৯৭২ সালের ৬ জুন আততায়ীর গুলিতে নির্মম ভাবে নিহত হন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও ভাষা সৈনিক এমএ গফুর। ১৯৯০ সালে মৃত্যুবরণ করেন সহধর্মিনী লায়লা বেগম।
বরেণ্য এ ব্যক্তির নামে জন্মস্থান হরিনগর ও পাইকগাছা সরল এলাকায় দু’টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উপজেলা সদরে একটি মিলনায়তন ও সরল এলাকার প্রাইমারী স্কুলের সাথেই একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হলেও প্রতিষ্ঠানগুলো পড়ে রয়েছে অবহেলায়। প্রতিবছরের মতো মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিল, এতিমদের মাঝে খাদ্য বিতরণ সহ নানা কর্মসূচীর মধ্যে দিয়ে পালিত হয়েছে বরেন্য এ ব্যক্তির মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার জুম্মাবাদ এলাকার মসজিদ গুলোতে দোয়া অনুষ্ঠিত হয় বলে এমএ গফুরের জৈষ্ঠ্য পুত্র ও পাইকগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার ইকবাল মন্টু জানিয়েছেন।
ভাষা আন্দোলনে এম এ গফুরের অবদান এলাকাবাসী স্মরণ করলেও আজও ভাষা সৈনিকের স্বীকৃতি মেলেনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শহীদ এমএ গফুরের। অনুরূপভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হওয়া স্বত্ত্বেও আজও মেলেনি স্বাধীনতা পদক। এ ব্যাপারে শহিদ এমএ গফুরের জৈষ্ঠ্য পুত্র উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ আনোয়ার ইকবাল মন্টু জানান, ভাষা আন্দোলনে খুলনার অবদানের বিষয়টি ইতিহাসে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। যার ফলে অনেকেরই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই মেলেনি। ওই সময় যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলো তাদেরকে ভাষা সৈনিকের স্বীকৃতি দিয়ে ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ করা উচিত। তিনি আওয়ামীলীগ ও দলীয় অঙ্গ সংগঠনের সকল নেতাকর্মী ও সর্বসাধারণের কাছে তাঁর পিতার আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়া কামনা করেছেন।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সাবেক এম এন এ শহীদ এম এ গফুর এর মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে শহীদ গফুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন উক্ত প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি জগদীশ চন্দ্র রায়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক এমপি এ্যাড. সোহরাব আলী সানা। বিশেষ অতিথি ছিলেন, মরহুম শহীদ গফুর এর জ্যেষ্ঠ পুত্র উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ আনোয়ার ইকবাল মন্টু, পৌর মেয়র সেলিম জাহাঙ্গীর, অধ্যক্ষ মিহির বরণ মন্ডল, ওসি (তদন্ত) তুষার কান্তি দাস, উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি সমিরণ সাধু, সাধারণ সম্পাদক শেখ কামরুল হাসান টিপু, যুগ্ম সম্পাদক আনন্দ মোহন বিশ্বাস, উপজেলা শিক্ষা অফিসার বিদ্যুৎ রঞ্জন সাহা, ইউআরসি ইন্সট্রাক্টর মোঃ ঈমান উদ্দীন, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রেশমা আক্তার, সহকারী শিক্ষা অফিসার মোঃ আসাদুজ্জামান, প্রধান শিক্ষক সেলিনা আক্তার ও মিলি জিয়াসমিন, নারায়ণ চন্দ্র শিকারী, জেলা সদস্য শেখ আনিছুর রহমান মুক্ত, অবঃ সহকারী অধ্যাপক জিএম আজহারুল ইসলাম। এসময়ে ইঞ্জিঃ মারুফ বিল্লা, ষোলআনা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জি এম শুকুরুজ্জামান, সদস্য হাবিবুর রহমান মুছা, যুবলীগ নেতা ফরহাদুজ্জামান তুষার, আরশাদ আলী বিশ্বাস, রাজু, নাজমা কামাল, ছাত্রলীগের রায়হান পারভেজ রনি, শিক্ষার্থী সহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। দোয়া অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মাওঃ রইসুল ইসলাম। দুপুরে দক্ষিণ গোপালপুর বায়তুল উলূম তালিমুল কুরআন মাদরসা ও এতিমখানা শিশুদের মাঝে খাবার বিতরণ করেন মরহুমের জ্যেষ্টপুত্র মন্টু।
পাঠকের মন্তব্য