ইসলামে সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের স্থান নেই

ইসলামে সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের স্থান নেই

ইসলামে সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের স্থান নেই

ইসলাম ধর্ম মতে, এক ও অভিন্ন উৎসমূল থেকে মানুষের সৃষ্টি। সব মানুষ হজরত আদম (আ.)-এর সন্তান। হজরত হাওয়া (আ.)-এর ঔরস থেকে মানব বংশের বিস্তার শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে আদম সন্তান বিভিন্ন গোত্র, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কেন এই বিভক্তির রেখা টেনে দেওয়া হলো? হ্যাঁ, যাতে মানুষ সামাজিক হতে পারে, বৈচিত্র্যের মধ্যেও ঐক্যের সূতিকায় আবদ্ধ হতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে। অতঃপর তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১৩)

মানুষকে বলা হয় সামাজিক জীব। সৃষ্টিগতভাবে সামাজিকতার উপাদান মানুষের মধ্যে রয়েছে। সব বিষয়ে কাউকে নিরঙ্কুশ ও সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। পদে পদে মানুষকে পরনির্ভর ও পরমুখাপেক্ষী হতে হয়। তথাপি মানুষ সামাজিকতার উপাদানগুলো উপেক্ষা করে অসামাজিক হয়ে ওঠে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, আদর্শিক লড়াইয়ে, পার্থিব দুনিয়ার মোহগ্রস্ত হয়ে মানুষ সংঘাতে লিপ্ত হয়। সহিংসতা ও সন্ত্রাস করে রক্তের হোলিখেলায় মেতে ওঠে। মানুষ এখন আর আগের মতো ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ করে না। শান্তির নামে, মানবতার নামে, ধর্মের নামে ও মানুষের অধিকার আদায়ের কথা বলে এসব হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। অথচ শান্তি, মানবতা, ধর্ম ও মানুষের অধিকারের সঙ্গে এসবের সম্পর্ক নেই।

মানুষ হত্যা, সন্ত্রাস ও ত্রাস সৃষ্টি যেকোনো ধর্ম, মতাদর্শ ও সভ্যতাবিরোধী। খুনাখুনি ও রক্তপাত কেউ পছন্দ করে না। এর পরও হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ও ক্ষমতার লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য আদর্শের উগ্র উন্মাদনায় মেতে ওঠে। পার্থিব-অপার্থিব কল্যাণের অলীক আশায় সন্ত্রাসীগোষ্ঠী হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই। তাদের ধর্ম সন্ত্রাস। সারা বিশ্বেই খুন-খারাবি হচ্ছে। ইসলাম গ্রহণের কারণে নয়, পূর্ণ ইসলাম না থাকার কারণেই মানুষ সন্ত্রাসী হয়। মুসলমান সন্ত্রাসী হওয়ার পথে কোরআনই সবচেয়ে বড় বাধা। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানে সে চিরকাল থাকবে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৯৩)

ইসলাম ধর্ম মতে, কোনো মুসলমান হাজারো অপরাধ করলেও তার সমুদয় পাপের সাজা ভোগ করে সে জান্নাতে যাবে। কোনো মুসলিম অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে না। অথচ এ আয়াতে হত্যাজনিত অপরাধের কারণে অনন্তকাল জাহান্নামে থাকার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, একটি অন্যায় হত্যাকে ইসলাম বিশ্বমানবতাকে হত্যার সমতুল্য বলে ঘোষণা করেছে। কোরআন বলছে, ‘নরহত্যা কিংবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ করা ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকেই হত্যা করল।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৩২)

কোথাও কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটতে দেখলে অন্যদের উচিত নির্যাতিত ব্যক্তির সাহায্যে এগিয়ে আসা। আল্লাহ বলেন, ‘আর যে কারো প্রাণ রক্ষা করল, সে যেন (বিশ্বের) সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৩২) এ ছাড়া বহু আয়াতে হত্যার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা একে অন্যের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না... এবং একে অন্যকে হত্যা কোরো না।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)

ইসলাম অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিমকেও হত্যায় উৎসাহিত করে না। আল্লাহ বলেন, ‘(রহমানের বান্দা তারাই) যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য উপাস্যর ইবাদত করে না, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে না।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৬৮)

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর মতে, এ আয়াতটি অমুসলিমদের হত্যার ব্যাপারে নাজিল হয়েছে। এ ছাড়া সুরা বনি ইসরাইলের ৯ নম্বর আয়াতে, সুরা বাকারার ৮৪-৮৫তম আয়াতে ও সুরা আনআমের ১৫১ নম্বর আয়াতে নরহত্যা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও কেউ কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে পরকালের শাস্তির পাশাপাশি পার্থিব জীবনেও তার জন্য মৃত্যুদণ্ড (কিসাস) কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এভাবেই ইসলাম হত্যা, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদীদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

ইসলাম কখনোই হত্যা, নৈরাজ্য সৃষ্টি, সহিংসতা ও সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেয় না। পৃথিবীতে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকে নিষেধ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হইও না। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে পছন্দ করে না।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৭৭)

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘ফিতনা (দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা ও গৃহযুদ্ধ) হত্যা অপেক্ষা গুরুতর।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯১)

অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করাকে ইসলাম বিশ্বমানবতার মৃত্যুতুল্য গণ্য করেছে। আর মুসলমানদের পারস্পরিক রক্তপাতের বিরুদ্ধে হাদিস শরিফে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো মুসলমানকে গালি দেওয়া গোনাহর কাজ আর তাকে হত্যা করা কুফরি।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০৪৪)

বর্তমান পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, একদল মুসলিম অন্য দলের ওপর অস্ত্রাঘাত করছে। অথচ রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের (মুসলমানদের) ওপর অস্ত্র উঠাবে, সে আমাদের (ধর্মের) দলভুক্ত না।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৮৪৪)

অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কাছে গোটা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোনো মুসলমানের হত্যার চেয়েও অধিক সহনীয়।’ (নাসায়ি শরিফ, হাদিস : ৩৯৯২)

কেউ অন্যায়ভাবে হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হলে ইসলাম তার জন্য মৃত্যুদণ্ড বা কিসাস আইন প্রবর্তন করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের জন্য কিসাসের বিধান দেওয়া হলো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৭৮)

ইসলামের মূল উৎস কোরআনে কারিম এবং হাদিস পরধর্মের মানুষকে আপনের চেয়েও বেশি শ্রদ্ধা ও সম্মান করার কথা বলেছে। ইতিহাস সাক্ষী, আমরা দেখেছি শেষ নবী হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আপনজনের অনেকেই ছিল ইসলামের কট্টর দুশমন।

তথাপি নবী করিম (সা.) তাদের প্রতি নির্যাতন তো দূরের কথা, তাদের প্রতি মৌখিক অভিযোগও উত্থাপন করেননি। বরং কোনো বিরোধী যখন অসুস্থ হতো, তখন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে দেখতে যেতেন।

হজরত রাসূলে কারিম (সা.)-এর এমন আন্তরিকতায় ওই বিরোধীরাও ধীরে ধীরে ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এই যখন মুসলমানের নবীর চরিত্র, তাহলে তারা কীভাবে মন্দিরে হামলা করতে পারে ?

একজন প্রকৃত মুসলমানের পক্ষে মন্দির ভাঙ্গা তো দূরের কথা মন্দির ভাঙ্গার চিন্তা করাও সম্ভব নয়।

কারণ, ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে, সংগ্রাম করে এবং জীবন উৎসর্গ করে তারা আমাদের দলভুক্ত নয়। ’ -সুনানে আবু দাউদ : ৫১২৩

সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে পবিত্র কোরআন।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে জোরজবরদস্তি নেই। ভ্রান্ত মত ও পথকে সঠিক মত ও পথ থেকে ছাঁটাই করে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। ’ -সূরা বাকারা : ২৫৬
সুতরাং ‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য, আমাদের ধর্ম আমাদের জন্য। ’ -সূরা কাফিরুন : ৫

একে অন্যের ধর্ম পালন করতে গিয়ে কেউ কোনোরূপ সীমা লঙ্ঘন কিংবা বাড়াবাড়ি করবে না। অন্য কেউ যদি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেও ফেলে তবে ভুলেও যেন কোনো ইমানদার এ ধরনের হীন ও জঘন্য কাজের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত না করে। এ বিষয়টিই নসিহতস্বরূপ মুমিনদের উদ্দেশে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব দেবদেবীর পূজা-উপাসনা করে, তোমরা তাদের গালি দিও না। যাতে করে তারা শিরক থেকে আরো অগ্রসর হয়ে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দিয়ে না বসে। ’ -সূরা আনআম: ১০৮

যেখানে অন্য ধর্মের দেবতাকে গালি দেওয়া নিষিদ্ধ সেখানে মন্দির ভাঙচুর ও মানুষ হত্যা কীভাবে বৈধ হতে পারে? একজন প্রকৃত মুসলমান কখনোই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অনুভূতিতে আঘাত আসে এমন কোনো কাজ করতে পারে না।

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান যদি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার ক্ষুন্ন করে কিংবা তাদের ওপর জুলুম করে, তবে কেয়ামতের দিন আমি মুহাম্মদ ওই মুসলমানের বিরুদ্ধে আল্লাহর আদালতে লড়াই করব। ’ –সুনানে আবু দাউদ : ৩০৫২

তিনি (সা.) আরও বলেছেন, ‘অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিমকে হত্যাকারী জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ চল্লিশ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেই ওই ঘ্রাণ পাওয়া যাবে। ’ –সহিহ বোখারি : ৩১৬৬

অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করবে আল্লাহতায়ালা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। ’ -সুনানে নাসাঈ : ৪৭৪৭

পাঠকের মন্তব্য