জীবন এখন জলবৎ তরলং

জীবন এখন জলবৎ তরলং

জীবন এখন জলবৎ তরলং

একটা সময় ছিল, যখন আমি রাত-বিরাতে এটিএন নিউজের রিপোর্টার আরাফাত সিদ্দিকীকে ফোন করে বিরক্ত করতাম। বলতাম, আমার ফোনে টাকা নাই, ফ্লেক্সি করেন। সে তার বিকাশ থেকে ফ্লেক্সি করে দিতো। আমি পরদিন টাকা দিয়ে দিতাম। মুখে না বললেও মনে মনে সে নিশ্চয়ই বিরক্ত হতো। একদিন বলেই ফেললো, আপনি একটা বিকাশ একাউন্ট খুলে ফেলেন। আমি সাধারণত কমফোর্ট জোনের বাইরে যেতে চাই না। তাই একটু দ্বিধা ছিল। তাছাড়া কীভাবে খুলবো, কোথায় যাবো? ইত্যাদি তো ছিলই। নিজের ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আরাফাতই সব করে দিলো। আমি খালি সই দিয়েছি। তবে টিভিতে দেখি এখন ঘরে বসেই বিকাশ একাউন্ট খোলা যায়। বিকাশ একাউন্ট খোলার পর হঠাৎ আমার নিজেকে বিশাল ক্ষমতাশালী মনে হতে লাগলো। আগে যেমন আমি আরাফাতের সাহায্য নিতাম। এখন আমি অনেককে সময়ে-অসময়ে ফ্লেক্সি করি। প্রথমে শুধু ফ্লেক্সির জন্য খোলা হলেও এখন দেখি বিকাশ মানে নিশ্চিন্ত নির্ভরতা। জীবনকে অনেক সহজ করে দেয় বিকাশ। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট থেকে শুরু করে নিত্য সব কাজেই বিকাশ থাকে পাশে। প্রসূনের কোচিং, স্কুলের বেতনও দেয়া যায় বিকাশে। করোনাকালে বিকাশ আরো অনেক সাহায্যকারী হয়ে এসেছে। এই যেমন আজ সকালে মোহাম্মদপুর টাউন হলে সুপারশপ স্বপ্নে ফোন করে আমার স্ত্রী মুক্তি বাজারের তালিকা বলে দিল, আমি বিকাশে পেমেন্ট করে দিলাম। হোটেলে, রেস্টুরেন্টে, দোকানে- বিকাশ এখন সর্বব্যাপী। জীবন এখন জলবৎ তরলং।

বিকাশ একাউন্ট খোলার সময় আমার কিছুটা দ্বিধা ছিল, এটা ভেবে আমি এখন লজ্জা পাই। এখন মনে হয়, আরো আগে কেন করিনি। এখন তো সবার হাতে হাতে বিকাশ। এখন উবারের বিল দেয়া যায় বিকাশে। আমার ধারণা কদিন পর রিকশাভাড়া, এমনকি ভিক্ষাও দেয়া যাবে বিকাশে। বিকাশই সত্যিকার অর্থে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা তৃণমূলে পৌছে দিয়েছে। ক্রেডিট কার্ড আসার পর কাগজের নোটের চাহিদা কমে যায়, আসে প্লাস্টিক মানির ধারণা। তবে ক্রেডিট কার্ড সামর্থ্যবান মানুষের জন্য। কিন্তু বিকাশ হলো সবার জন্য। পকেটে বিকাশ থাকলে, কাগজের নোট না থাকলেও চলে। গ্রামীণ অর্থনীতির অনেক বড় লাইফলাইন এখন বিকাশ।

আমাদের বন্ধু, তারকা সাংবাদিক শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম এখন বিকাশের জনসংযোগ কর্মকর্তা। তিনি জানালেন, এবার থেকে আয়করও ঘরে বসে বিকাশে দেয়া যাবে। আপনি বিকাশ অ্যাপে ঢুকে ‘আয়কর প্রদান’এ ক্লিক করে ধারাবাহিকভাবে তথ্য দিয়ে ঘরে বসেই আয়কর দিতে পারবেন। এবার তো আয়কর মেলা নেই, সাথে আছে করোনা আতঙ্ক। ভয়কে জয় করে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ঘরে বসেই আয়কর বিকাশ করতে পারবেন। আমি ভাবছি, আর কী বাকি থাকবে? বিকাশ তো গোটা জাতিকে আলসে বানিয়ে ছাড়বে দেখছি।

বিকাশের সবাই ভালো। কিছুই কি মন্দ নেই? আছে আছে। অভিযোগটা করার জন্যই এত লম্বা ফিরিস্তি। প্রথম কথা হলো, প্রতারকদের ব্যাপক বিস্তার। কদিন আগে এক হতদরিদ্র ফোন করে কান্নাকাটি, বিকাশ প্রতারকরা তার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে। আমি জানি তার কাছে ১০ হাজার অনেক টাকা। তাকে কোনো সান্তনাও দিতে পারিনি। কদিন আগে আমাকে একজন ফোন করে বলেছিল, আমার একাউন্ট বন্ধ করে দেবে। আমি নির্বিকার চিত্তে বলে দিয়েছি, দেন। এরপর সে আর কথা বাড়ায়নি, ফোন বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু সবাই এতটা নির্বিকার থাকতে পারেন না। ভয়ে বা লোভে ফাঁদে পা দেন। মাঝে মাঝে পুলিশ বিকাশ প্রতারকদের ধরে বটে, কিন্তু তবু প্রতারকরা থেমে নেই। প্রতারকদের সাথে বিকাশের কোনোই সম্পর্ক নেই। তবু প্রতারকদের ঠেকাতে মানুষের আরো বেশি সচেতনতা যেমন দরকার, তেমনি দরকার বিকাশের কঠোর নজরদারি। শেষ কিন্তু মূল অভিযোগ হলো, বিকাশের চার্জ। টাকা তুলতে গেলেই গায়ে লাগে। এখন তো কাউকে টাকা পাঠালে চার্জসহ পাঠাতে হয়। কদিন আগে জানলাম, ক্রেডিট কার্ডের বিলও বিকাশে দেয়া যাবে। আমি তো মহা খুশী। এই একটা কাজেই এখনও বাইরে যেতে হয়। মনের আনন্দে ক্রেডিট কার্ডের বিল দিলাম বিকাশে। কিন্তু আনন্দটা চুপসে গেল নিমেষেই, যখন দেখলাম, বিকাশ বেশ ভালো চার্জ কেটেছে। ক্রেডিট কার্ডগুলোতে কেনাকাটা করলেই পয়েন্ট বা ছাড় পাওয়া যায়। বিকাশে উল্টো দিতে হয়। তাও অনেক বেশি। অনেকে বলতে পারেন, বিকাশ আমাকে এত সার্ভিস দেবে, চার্জ না কাটলে তারা চলবে কীভাবে? খুবই ন্যায্য প্রশ্ন। কিন্তু বিকাশের চার্জটা একটু বেশিই। সুবিধায় বিকাশ যেমন টপ ক্লাশ, চার্জেও। এই চার্জের ব্যাপারে বাংলাদেশ বা সরকারের কোনো নিয়ম-নীতি আছে কিনা জানি না। বিকাশ যেহেতু এখন সত্যিকার অর্থেই তৃণমূলে পৌছে গেছে। তাই চার্জের যন্ত্রণাটাও বিস্তৃত বাংলার পথে-প্রান্তরে। সরকারেরও তাই উচিত বিকাশ, রকেট, নগদের মত মোবাইল ব্যাংকিংকে উৎসাহিত করা এবং ব্যাংক ঋণের সুদের মত, তাদেও চার্জেরও একটা লিমিট বেধে দেয়া। একেক প্রতিষ্ঠানের একেকরকম চার্জ বাজারকে অস্থিরই করবে শুধু। একটা শৃঙ্খলা দরকার।

ফেসবুক স্ট্যাটাস লিঙ্ক : প্রভাষ আমিন 
লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

পাঠকের মন্তব্য