মাহে রমজানের ফজিলত ও তার হুকম-আহকাম

মাহে রমজানের ফজিলত ও তার হুকম-আহকাম
মো: শাকিল আহম্মেদ : আরবি মাসগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মাস হলো রমজান মাস। রমজান মাস মুসলমানদের জন্য এক বিশেষ নিয়ামাত। এটি আত্মশুদ্ধি,আত্মসংযম ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাস। এই মাসে বান্দার আমলের ছাওয়াব বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং অসংখ্য মানুষের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। এই বরকতময় মাসের রোজা পালন মহান আল্লাহ তা'য়ালার সান্নিধ্য ও তাকওয়ার লাভের অন্যতম মাধ্যম। মহান আল্লাহ্ তা'য়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, "হে ঈমানদারগন! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কারী হতে পারো।" [সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৩]
আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন এই মাসেই অবতীর্ণ করেছেন মানব জাতির ইহকাল ও পরকালীন কল্যাণের জন্য। আল্লাহ তা'য়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, "রমজান হলো এমন একটি মাস, যে মাসে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। এতে রয়েছে মানুষের জন্য হেদায়াত এবং পথ চলার নির্দেশিকা ও সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করার সুস্পষ্ট প্রমাণ।"[সুরা বাকারা,আয়াত: ১৮৫]
মাহে রমজান মাসের ফযিলাত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "বরকতময় মাস তোমাদের দুয়ারে উপস্থিত। পুরো মাস রোযা পালন আল্লাহ তোমাদের জন্য ফরয করে দিয়েছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়,বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। সেই সাথে দুষ্ট শয়তানদের এ মাসে শৃংখলাবদ্ধ করে দেয়া হয়। রাসূলে করীম (সা.) বলেন, "এ মাসে আল্লাহ কর্তৃক একটি রাত প্রদত্ত হয়েছে, যা হাজার মাস থেকেও উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল, সে বঞ্চিত হল মহা কল্যাণ হতে।" [সুনানে আত-তিরমিযি: ৬৮৩]
এছাড়াও এই মাসে যে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একটি নফল আমল করলো সে ঐ ব্যক্তির সমান হবে, যে অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করলো। আর যে ব্যক্তি এই মাসে একটি ফরজ আদায় করলো সে ঐ ব্যক্তির সমান হলো, সে অন্য মাসে ৭০টি ফরজ আদায় করলো। শুধু তাই নয় রোজাদারদের জন্য জান্নাতকে প্রতিদিন সুসজ্জিত করা হয়। আর রোজাদারদের জন্য বিশেষ পুরস্কার হলো, জান্নাতে রাইয়ান নামক একটি বিশেষ দরজা, যা দিয়ে একমাত্র রোজাদাররাই প্রবেশ করবে। রাসূল (সা.) আরো বলেন, "রোজা ও কোরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও যৌন সম্ভোগ থেকে পূর্ণ বিরত রেখেছি। তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। আর কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। কাজেই তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। অতঃপর তাদের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।"[মুসনাদে আহমাদ]
রমজান মাসের অন্যতম ইবাদত হলো তারাবির নামাজ আদায়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.)বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)বলেন, "যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে ও সওয়াবের উদ্দেশ্যে রমজান মাসে রাত জেগে তারাবির নামাজ আদায় করবে, তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।" [সহিহ আল-বুখারি]
এই মাসে কোন রোজদার কে যদি কেউ ইফতার করায় তাহলে সে রোজাদারদের অনুরুপ সাওয়াব লাভ করবে। রাসূল (সা.) বলেন,"যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে তার অনুরূপ প্রতিদান লাভ করবে। তবে রোজাদারের প্রতিদান থেকে বিন্দু মাত্রও হ্রাস করা হবে না।" [সুনানে আত-তিরমিজি: ৮০৭]
এই বরকতম মাস পেয়েও যে গুনাহ মাফ করাতে পারলা না তার মত হতভাগা আর কেউ হতে পারে না। কেননা, হযরত কা'ব ইবন উজরা (রা.) বর্ণনা করেন,একবার রাসূল (সা.)বলিলেন, "তোমরা মিম্বারের কাছে আসিয়া যাও। আমরা মিম্বারের কাছে আসিয়া গেলাম। তিনি যখন মিম্বারের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখিলেন তখন বলিলেন, 'আমিন'। যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখিলেন তখনও বলিলেন, 'আমিন'। যখন তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখিলেন তখনও বলিলেন, 'আমিন'। যখন তিনি খুৎবা শেষ করিয়ে মিম্বার হইতে নামিলেন তখন আমরা আরজ করিলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনাকে মিম্বারে উঠিবার সময় এমন কিছু কথা বলিতে শুনিয়াছি যাহা পূর্বে কখনোও শুনি নাই। উত্তরে রাসূল (সা.) বলিলেন, এইমাত্র জিবরাঈল (আঃ) আমার কাছে আসিয়াছিলেন। আমি যখন প্রথম সিঁড়িতে পা রাখি তখন তিনি বলিলেন, ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তি যে রমযান মাস পেয়েও তাহার গোনাহ মাফ করাইতে পারিল না। আমি বলিলাম, 'আমিন'। যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখি তখন তিনি বলিলেন, ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তি যাহার সম্মুখে আপনার নাম উচ্চারণ করা হয় কিন্তু সে আপনার প্রতি দুরুদ পড়ে না। আমি বলিলাম, 'আমিন'। যখন তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখি তখন তিনি বলিলেন, ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তি যে পিতামাতা উভয়কে অথবা তাদের কোন একজনকে বৃদ্ধাবস্হায় পাইল কিন্তু তাহারা তাহাকে জান্নাতে প্রবেশ করাইল না। আমি বলিলাম 'আমিন'।" [সহিহ আল-বুখারি শরীফ]
এখন রোজার কিছু হুকুম আহকাম নিয়ে আলোচনা করা যাক। যেগুলো জানা আমাদের জন্য অতি জরুরি।আমরা জানি রোজা একটি ফরজ ইবাদত।তবে সকলের ওপর ফরজ নয়। এর জন্য কিছু শর্ত প্রযোজ্য।
১. মুসলিম হতে হবে। কেননা অমুসলিম এর উপর এটি ফরজ নয়।
২. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া।অর্থ্যাৎ অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ের ওপর রোজা ফরজ নয়।
৩. জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া। অর্থাৎ মস্তিষ্ক বিকৃত লোকের ওপর রোজা ফরজ নয়।
৪. সুস্থ হওয়া এবং
৫. মুক্বীম হওয়া। আবার কোন ওজর ছাড়া রোজা ভঙ্গা করাও উচিত না।
কেননা হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি বিনা ওজরে ইচ্ছাপূর্বক রমজানের একটি রোজা ভঙ্গ করেছে, অন্য সময়ের সারা জীবনের রোজা তার সমকক্ষ হবে না। আর বিনা কারণে রোজা ভঙ্গ করলে তাকে অবশ্যই কাজা-কাফফারা উভয়ই আদায় করা ওয়াজিব।" যতটি রোজা ভঙ্গ হবে, ততটি রোজা আদায় করতে হবে। কাজা রোজা একটির পরিবর্তে একটি অর্থাৎ রোজার কাজা হিসেবে শুধু একটি রোজাই যথেষ্ট।আর কাফফারা আদায় করার তিনটি বিধান রয়েছে। একটি রোজা ভঙ্গের জন্য একাধারে ৬০টি রোজা রাখতে হবে। কাফফারা ধারাবাহিকভাবে ৬০টি রোজার মাঝে কোনো একটি ভঙ্গ হলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। যদি কারও জন্য ৬০টি রোজা পালন সম্ভব না হয় তবে ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা খাওয়াতে হবে। কেউ অসুস্থতাজনিত কারণে রোজা রাখার ক্ষমতা না থাকলে ৬০ জন ফকির, মিসকিন, গরিব বা অসহায়কে প্রতিদিন দুই বেলা করে পেট ভরে খাওয়াতে হবে।
রোজার কিছু সুন্নাতসমূহ : শেষ রাতে সাহরী খাওয়া। রাসূল (সা.) বলেছেন, "তোমরা সাহরী খাও। কেননা, সাহরীর ভিতরে বরকত রয়েছে" [মিশকাত শরীফ]। শেষ রাতে বিলম্বে সাহরী খাওয়া সুন্নাত। তবে এমন দেরি করবে না যাতে সুবহে সাদিক প্রকাশ পাওয়ার আশংকা হয়। সূর্য অস্ত যাওয়া মাত্রই তাড়াতাড়ি ইফতার করা খেজুর দ্বারা ইফতার করা সুন্নাত ইত্যাদি।
রোজা ভঙ্গ হবার কারণসমূহ : রোজা রেখে সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত হবার পূর্ব সময়ে ইচ্ছাপূর্বক পানাহার অথবা স্ত্রীর সহিত সহবাস করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। এ অবস্থায় রোজার কাযা এবং কাফফারা উভয়ই আদায় ওয়াজিব হবে। স্বেচ্ছায় মুখ ভরে বমি করলে। ইচ্ছাকৃতভাবে বীর্যস্থলন করলে। ঋতুস্রাব এবং প্রসবোত্তর স্রাব শুরু হলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। এ অবস্থায় রোজা ও নামাজ ছেড়ে দিতে হবে এবং সুস্থ হলে রোজা ও নামাজের কাযা আদায় করতে হবে। এক্ষেত্রে রোজার কাযা আদায় করলেই চলবে কোন কাফফারা দিতে হবে না। নাকে বা কানে তৈল বা ঔষধ প্রবেশ করালে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে।
রোজা ভঙ্গ হয় না যে সব কারণে : রোজার কথা ভুলে পানাহার করলে। সুগন্ধি ব্যবহার করলে। মুখের থুথু-কফ জমা না করে গিলে ফেললে। দিনের বেলা ঘুমের মধ্যে স্বপ্নদোষ হলে। অনিচ্ছকৃতভাবে বমি করলে। চোখে সুরমা বা ঔষধ ব্যবহার করলে।
যেসব কারণে রোজা ভঙ্গ হয় এবং ক্বাযা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হয় : ইচ্ছাকৃত নির্জনবাস করলে। স্বেচ্ছায় পানাহার করলে। স্বেচ্ছায় ওষুধ পান করলে এবং শিঙ্গা লাগানোর পর রোযা নষ্ট হয়েছে মনে করে পানাহার করলে ইত্যাদি।
গর্ভবতী নারীদের রোযা রাখার হুকুম হলো : গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিণী যদি আশঙ্কাবোধ করে যে,রোযা রাখলে যথাক্রমে তাদের গর্ভস্থ ভ্রুণ ও দুগ্ধপানকারী সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাহলে তাদের জন্য রোযা না রাখা জায়েয। পরে এর ক্বাযা আদায় করে নিতে হবে। কাফফারা বা ফিদিয়া প্রদান করতে হবে না। আর অতিশয় বৃদ্ধ যে রোযা রাখতে অক্ষম তার জন্য অনুমতি রয়েছে যে, সে রোযা ভঙ্গ করতে পারবে এবং প্রতিদিনের রোযার পরিবর্তে একজন মিসকীনকে তৃপ্তি সহকারে দু'বেলা খাওয়াতে হবে।
সর্বোপরি, রোজা আমাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং শিক্ষা দেয় সুশৃঙ্খলভাবে চলতে। রোজা পার্থিব লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে। তাই, এই মাসকে আমরা যথাযথ কাজে লাগিয়ে আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও তার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি সেই প্রচেষ্টা করা। অতএব, আল্লাহ পাক আমাদেরকে রোজার পূর্ণাঙ্গ হক আদায় করে রোজা পালনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
শিক্ষার্থী, মো: শাকিল আহম্মেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
পাঠকের মন্তব্য