সুসময় ও দুঃসময়ের রাজনীতি এবং সেলিব্রিটিদের আজকাল 

সুসময় ও দুঃসময়ের রাজনীতি এবং সেলিব্রিটিদের আজকাল 

সুসময় ও দুঃসময়ের রাজনীতি এবং সেলিব্রিটিদের আজকাল 

ভারত-পাকিস্তান-নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ক্রিকেট কিংবা সিনেমা কিংবা সংগীতজগতের সেলিব্রিটিদের কদর তো কয়েক দশক ধরেই আছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সেই প্রবণতা বহুগুণ বেড়ে গেছে। সেলিব্রিটিদের হরেদরে প্রার্থী করে নির্বাচনী বৈতরণি শুধু পাড়ি দেওয়া নয়, প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করে দেওয়া যায়, তার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত সীমানার ওপারের পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

বর্তমান জাতীয় সংসদে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা, জনপ্রিয় লোকসংগীত শিল্পী মমতাজ বেগম, চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুক, ক্রিকেটার নাঈমুর রহমান খান দুর্জয়, ফুটবলার সালাম মুর্শেদীসহ কয়েকজন সেলিব্রিটি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রয়েছেন। সেলিব্রিটিদের প্রার্থী করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই বিএনপিও। সংগীতশিল্পী কনকচাঁপা, বেবী নাজনীন, চিত্রনায়ক হেলাল খান, ফুটবলার আমিনুল ইসলামের নাম সংসদ সদস্য মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে শোনা গেছে।

একসময় রাজনীতিকেরা জনমানুষের কাছে আইডল হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বেশির ভাগ রাজনীতিক আইডল দূরে থাক মানুষের ন্যূনতম ‘ভক্তি-শ্রদ্ধা’ অর্জনে চরমভাবে ব্যর্থ। বাস্তব জগতে কোনো আইডল যখন নেই, তখন পর্দার কিংবা মাঠের সেলিব্রিটিরাই জনমানুষের কাছে আইডল হিসেবে হাজির হচ্ছেন। তাদের প্রার্থী করে নিজেদের শোচনীয় রাজনৈতিক ব্যর্থতাকে ঢাকার চেষ্টা করছে রাজনৈতিক দলগুলো।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সেলিব্রিটিদের কদর আর রাজনীতি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী বিষয়। ছাত্রজীবন থেকে গণমানুষের রাজনীতির অভিজ্ঞতা যার নেই তিনি কখনোই ভালো জনপ্রতিনিধি হতে পারেন না। 

নিজের সেলিব্রিটি তকমার জোরে তারা দলকে একটা আসন হয়তো পাইয়ে দিতে পারেন। কিন্তু তারা না হন দক্ষ জনপ্রতিনিধি, না হন ভালো নেতা। দল ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তাদের রাজনীতিক অদক্ষতা অনুমান করা না যায় না বলে হয়তো উতরে যান। কিন্তু দলের ক্রান্তিকালে বোঝা যায়, তাদের দৌড় কতোটা। তারা রাজপথে নেমে দলের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করবে না।

কারণ আন্দোলন-সংগ্রাম করার পূর্ব অভিজ্ঞতা বা ক্ষমতা কোনোটাই নেই। তারা সেটা করবেও না। কারণ তাতে করে তাদের ক্লিনইমেজ তকমা হারাতে হবে। বড় আজব আমাদের দেশের রাজনীতি। কেউ দলের জন্য খাটতে খাটতে নিজের গোটা জীবন-যৌবন ব্যয় করে দেয়। 

কেউ কেউ সংসারটা পর্যন্ত করতে পারে না। করলেও স্ত্রী-সন্তানকে সারাটা জীবন বঞ্চিত করতে হয় শুধু দল করতে গিয়ে। অথচ এতোসব ত্যাগের বিনিময়ে বেশিরভাগ সময় দলের একটা পোস্ট তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি পদে মনোনয়নও দেয় না। অপরদিকে খেলার মাঠে নিম্ন-মাঝারি গোছের পারফর্মেন্স করে কেউ অবসরে দলের মনোনয়নে সাংসদ হয়ে যায়, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে চলে আসে। দলের বিপদকালে তারা লেজ-গুটিয়ে গর্তে ঢুকে যায়।

অপরদিকে চিরবঞ্চিত সেই ছেলেগুলো অপ্রাপ্তির সমস্ত অভিমান ভুলে রাজপথে নেমে পিঠ বিছিয়ে দেয় প্রতিপক্ষের লাঠির কাছে, বুক পেতে দেয় প্রশাসনের টিয়ারগ্যাস আর জলকামানের সামনে। রাষ্ট্রের বড় কোনো অর্জন রাজনীতি ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে সম্ভব নয়। 

ইতিহাস সাক্ষী দেয়- প্রীতিলতা, মাস্টারদা সূর্য্যসেন, কল্পনা দত্তরা বয়ঃসন্ধি থেকে বৃটিশবিরোধী রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পরাধীন ভারতবর্ষ স্বাধীন করেছিলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্কুলজীবন থেকে রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি উপনিবেশবাদ থেকে দেশকে মুক্ত করেছিলো। সুদীর্ঘ আন্দোলন, লড়াই, সংগ্রাম, মিছিল-মিটিং শ্লোগান আর হাজার হাজার মানুষ প্রতিনিধিত্ব করতে করতে রাজনীতির পদে আসিন হতে হয়।

অরাজনীতিক ব্যক্তিকে রাজনীতির পদ পদবিতে বসিয়ে দিলে দলের সাময়িক কিছু লাভ হয়তো হয়, কিন্তু রাজনীতির দীর্ঘ পথপরিক্রমায় এতে দলের অপূরণীয় ক্ষতি হতে বাধ্য। আমাদের দেশের রাজনীতিকদলগুলোকে এই সত্য অনুধাবন করতে হবে। তা না হলে দলের সাথে সাথে দেশটাও ডুববে। 

দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা এমন এক জায়গায় এসে দাঁড় করানো হয়েছে যে সংসদ সদস্য বা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে এখন আর ভোটারের মন জয় করে আসতে হয় না। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পরও কোনো অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন করতে হয় না। ফলে সংসদ সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় মনোনয়ন পাওয়াটাই প্রধান বাধা। চেষ্টা-তদবির অথবা অন্য যেকোনো কায়দায় মনোনয়ন বাগানোটাই মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বড় কাজ। কে, কত বছর মাঠের রাজনীতি করে এসেছে, দলের জন্য কার ত্যাগ কত বেশি, কিংবা জনগণের সঙ্গে কার সম্পৃক্ততা আছে, সেগুলো দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সাবেক আমলা, উকিল–চিকিৎসক, পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এগিয়ে থাকেন প্রতিযোগিতার দৌড়ে। 

এমনও দেখা যায়, মনোনয়ন পাওয়ার আগে দলের নেতা-কর্মীরাও তাঁদের প্রার্থীকে চেনেন না। ফলে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকুক আর না-ই থাকুক, যে কেউই সংসদ সদস্য হতে চান। এ বাস্তবতায় মাহি যখন ‘আপনার তো কোনো রাজনৈতিক অতীত নেই’—প্রশ্নে ফোন কেটে দেন, তাতে অবাক হওয়ার কি কোনো কারণ থাকে ?

মাহিয়া মাহি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন মনোনয়ন পেতে তিনি আগ্রহী। তিনি বলেছেন, ‘সব প্রার্থীই নিজেকে যোগ্য মনে করেন, সেই অর্থে আমিও নিজেকে যোগ্য মনে করি। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নারীদের ক্ষমতায়নে আগ্রহী। নারী হিসেবে তাই আমি আশাবাদী।’

   


পাঠকের মন্তব্য