কৃষকের ঘরে ঘরে এবি ব্যাংকের ঋণ উৎসব

মিয়া মনসফ, সভাপতি, কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা

মিয়া মনসফ, সভাপতি, কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা

মিয়া মনসফ : বাংলাদেশের কৃষককুলকে জীবনযোদ্ধা বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবেনা। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে তাদের এই যুদ্ধে যুক্ত হতে হয়। সংসারে অভাব অনটনের যুদ্ধ ! প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উৎপাদিত ফসল বাঁচানোর যুদ্ধ! এনজিও বা দাদনদাতাদের অত্যাচার সহ্য করার যুদ্ধ! এমন সব যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে কৃষক বাঁচার চেষ্টা করে। ‍যদি কৃষক কোন সাহায্যের হাত খুঁজে পায়, তা কৃষকের জন্য ঈদের আনন্দ বটে। 

এবি ব্যাংক ইতিমধ্যে দেশের প্রায় এক পঞ্চমাংশ জেলার যে পনের হাজার কৃষককে স্বল্প সুদে স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে কৃষি ঋণ দিয়েছেন তা হয়তো দেশের মোট কৃষকের তুলনায় নগণ্য। কিন্তু যারা পেয়েছেন তাদের কাছে এই ঋণ মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।

এই সুযোগটা করে দিয়েছে বাংলাদেশের বেসরকারি এবি ব্যাংক লিঃ। এদেশের কৃষকের কথা ভেবে এবি ব্যাংক নিজস্ব সিদ্ধান্তে এই কর্মসূচি নিয়েছে। এবি ব্যাংকের এই ঋণ বিতরণ কর্মসূচি প্রশংসিত হচ্ছে সর্বমহলে। যে কৃষক ঋণ পেয়েছে সেই কৃষকের ঘরে আনন্দের জোয়ার বইছে। সেই আনন্দ চোখে পড়লো গোপালগঞ্জ টু দিনাজপুর। এ বছরের শুরুতে এবি ব্যাংক স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে ঋণ বিতরণ শুরু করে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া থেকে। সর্বশেষ দিনাজপুর গোর এ শহীদ বড় ময়দানে সদর এলাকার কৃষকদের মাঝে ঋণ বিতরণ করা হয়। 

ঐতিহাসিক গোর এ শহীদ বড় ময়দানে সেদিন বিশাল প্যান্ডেলের নিচে বসে থাকে উচ্ছ্বসিত কৃষক ঋণের অপেক্ষায় যখন বসে আছে, তখন প্রচন্ড রোদের তাপও ঋণ প্রত্যাশী কৃষকদের হাসিমুখ ম্লান করতে পারেনি। একজন কৃষককে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম তিনি টাকার অভাবে নিজের সব কৃষি জমিতে চাষ করতে পারেনা। এবি ব্যাংকের স্মার্টকার্ডে ঋণ বিতরণের সুযোগ নিতে এসেছেন। আমার কাছে জানতে চাইলেন তার কাছে মোবাইলে মেসেজ আসবে তো! তাকে আশ্বস্থ করে বললাম যেহেতু ঋণের জন্য আপনি তালিকায় নিবন্ধিত হয়েছেন নিশ্চয়ই ঋণ পাবেন! এই কৃষক খুশিতে মুহূর্তেই অন্য কৃষকদের সাথে মিশে গেলো। ঋণ প্রত্যাশী কৃষকের এত আনন্দের কারণ এবি ব্যাংকের ঋণ প্রাপ্তির প্রত্যাশায়। কেউবা ইতিমধ্যে ঋণ পেয়েছেন। কোন ঝক্কি ঝামেলা ছাড়া, কোন তদবির বা উৎকোচ ছাড়া যারা ঋণ পেয়েছেন তারা তো নিজেদের ভাগ্যবানই ভাবতে পারেন!

প্রায় দেড় ঘন্টার ঋণ বিতরণ কর্মসূচির অনুষ্ঠানে অতিথিদের মধ্যে কৃষি বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ বক্তব্য রেখেছেন। তাঁরা কৃষি বিষয়ক অনেক তথ্য তুলে ধরেছেন। দিনাজপুর দেশের ৫টি জেলার মধ্যে কৃষি পণ্য উৎপাদনে অন্যতম জেলা তথ্যও জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে ধান, ভুট্টা, লিচুর পাশাপাশি নতুন নতুন শষ্য উৎপাদনের আশার কথাও জানিয়েছেন। এসব তথ্য কৃষকদের যেমন আশাবাদী করে তুলছে তেমনি এদেশের মানুষ হিসেবে আমরাও আশ্বস্থ হচ্ছি, এদেশের কৃষক তাদের উৎপাদিত শস্যে আমাদের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হচ্ছেন। দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।

ঋণ বিতরণ কর্মসূচি শেষে বিকেলে একটি সাংগঠনিক বৈঠকে অংশ নিয়ে একজন তরুণ উদ্যোক্তার সাথে পরিচয় হয়। মোসাদ্দেক হোসেন নামে এই তরুণ একজন উচ্চ শিক্ষিত। উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে মাস্টার্স করেছেন। তিনি চাকুরীর পেছনে না ঘুরে তরুণ উদ্যোক্তা হয়েছেন। গড়ে তুলেছেন অন্যরকম এক শিল্প প্রতিষ্ঠান। লিচু বাগান ভিত্তিক মধু উৎপাদন করাই এই উদ্যোক্তার লক্ষ্য। তিনি জানালেন দিনাজপুরে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়। লিচু বাগান ভিত্তিক মধু উৎপাদন করা গেলে দিনাজপুরকে মধু জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে। সেই সাথে লিচুর উৎপাদনও ৩০শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। 

ইতিমধ্যে মোসাদ্দেক হোসেনের প্রতিষ্ঠিত ‘এমবি এফ হানি’ নামে মধু উৎপাদনের প্রতিষ্ঠানটি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক) এর স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ৪ শতাধিক তরুনকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। এই তরুণরাও আত্মকর্মস্থানের সুযোগ পাবে। দিনাজপুরে উৎপাদিত পণ্যের সাথে আরেক পণ্যে যুক্ত হবে। সে পণ্যটি স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান মধু।

এবি ব্যাংক যে সকল কৃষককে ঋণ দিচ্ছেন, তারা ধান, গম, ভুট্টা, হাসমুরগী, গরু ছাগল উৎপাদনকারী কৃষকরাই কৃষি ঋণ পেয়ে থাকেন। মধু উৎপাদনকারীরাও ঋণের আওতায় অন্তর্ভুক্ত হলে অনেক তরুণ  মধু চাষকে এগিয়ে নিতে পারবে এবং তরুণ কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে।

ভেবেছিলাম এবি ব্যাংকের পথ ধরে অন্যান্য ব্যাংকও এগিয়ে আসবে কৃষি ঋণ বিতরণে। কিন্তু এখনো আসেনি। এদেশে প্রায় চল্লিশটির উপরে বেসরকারী ব্যাংক রয়েছে। তারা প্রত্যেকে স্ব উদ্যোগে যদি এবি ব্যাংকের মতো এগিয়ে আসতো তাহলে এদেশের বেশিরভাগ কৃষক ঋণ প্রাপ্ত হতো। ফলে কৃষক তাদের উৎপাদন বাড়াতে পারতো। দেশের খাদ্যাভাব দূর হতো। ইউরোপের দেশগুলো বৈশ্বিক উঞ্চতার কারণে এখন খরতাপে পুড়ছে। কৃষি উৎপাদন থমকে গেছে। পৃথিবী যেভাবে খাদ্য সংকটের দিকে যাচ্ছে, আমাদের ‍খাদ্য উৎপাদনে মনোনিবেশ করা ছাড়া কোন উপায় নাই। 

রাষ্ট্রের অভিভাবক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়েছেন প্রতি ইঞ্চি জায়গা আবাদের আওতায় আনতে! তিনি এ নির্দেশ দিয়েছেন দেশের মানুষকে। তাহলে প্রতি ইঞ্চি জায়গা কাজে লাগাতে হলে, আবাদের আওতায় আনতে হলে আর্থিক সহযোগিতা জরুরি। এই সহযোগিতা ব্যক্তি বা সংস্থা দেবেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থাকে। 

যারা কৃষি উৎপাদনের সাথে। এদেশের বেশিরভাগ মানুষের পেশা কৃষি। এদেশের সকল কৃষক আধুনিক কৃষির সাথে পরিচিত নয়। পুরানো ধারায় কৃষি কাজ করেন। আস্তে আস্তে আধুনিক কৃষি চাষে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। এতে টাকার প্রয়োজন। 

আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হলে উৎপাদন বাড়বে সে কথা কৃষক জানেন। কিন্তু সেই কৃষি উপকরণ কৃষক পাবে কোথায়! তাই কৃষককে সহযোগিতা দিয়ে কৃষি বাড়ালে এতে উপকার শুধু কৃষকের নয়। এতে দেশের অর্থনীতির উন্নতি হবে। দেশের মানুষ খাদ্য পাবে।  তাহলে এই খাতে ব্যাংক বা বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে না আসার কারণ দেখিনা। শুধু সাহস ও সদিচ্ছার প্রয়োজন।

একথা সত্য ব্যাংক ঋণ দেয় শিল্প কারখানায়। এতে সুদ বেশি। শিল্পকারখানা থেকে আয় বেশি হয় বলে শিল্পকারখানায় ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে বেশি ‍উৎসাহী হয়। তাই বলে সবক্ষেত্রে  সমান প্রত্যাশা করা ঠিক নয়। 

দায়বদ্ধতা থেকে কোন কোন ক্ষেত্রে বেশি লাভ প্রত্যাশা করাও যায়না। বেসরকারি ব্যাংকের যাঁরা শীর্ষ ব্যক্তি থাকেন তাদের একটু সাহসী হতে হয়। ব্যাংকের অংশীদার মালিকদের বোঝাতে হয় দেশ ও মানুষের প্রতি ব্যাংকের দায়িত্ব আছে। এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আফজালের দায়িত্বশীল ভূমিকার কারণে কৃষকদের মাঝে মাত্র ন্যূনতম সুদে ঋণ বিতরণ সম্ভব হয়েছে। তিনি দেশের কৃষক ও কৃষি উৎপাদনকে প্রাধান্য দিয়ে কৃষককে এই সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। রাষ্ট্রের অভিভাবক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর উপর কেন গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি তা অনুধাবন করেছেন। 

দেশের কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে সবচেয়ে বড় লাভ মনে করে বছরের শুরু থেকে প্রায় মধ্যভাগে এসেও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে স্মার্টকার্ডে ঋণ বিতরণ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন।  এতে ব্যাংক দেওলিয়া হয়ে যাবেনা। হয়তো শিল্প প্রতিষ্ঠানের মতো লভ্যাংশ কম পাওয়া যাবে। কিন্তু অন্যদিকের লাভটা তো কম নয়। 

কৃষক তার উৎপাদন বাড়াতে পারলো। ফলে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করার সুযোগ পেলো। অন্যদিকে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা মজবুত হলো। ব্যাংকের কোষাগারে টাকা ভর্তি রেখে কোন লাভ হবেনা যদি দেশে খাদ্য নিরাপত্তা না থাকে। বিদেশ থেকে খাদ্য আমাদানী করার মতো অবস্থাও যদি না থাকে। 

আমাদের এই দেশ পাহাড় ও সমুদ্র বেষ্টিত একটি দেশ। এরকম দেশ খুব কমই আছে। অথচ সমতল, পাহাড় ও সমুদ্র পর্যন্ত আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পারি। শুধু সদিচ্ছা যথার্থ কাজে লাগানো। সরকার ও বেসরকারি পর্যায়ে এই সচেতনতা আমাদের বড় বেশি প্রয়োজন। আগামীতে জনসংখ্যা বাড়বে বৈ কমবেনা সেই বিষয়টার দিকে দৃষ্টি দিয়ে কৃষি উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে হবে। এবি ব্যাংকের মতো সকল প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে কৃষকদের সহযোগিতায়। যে দেশ খাদ্যে যত স্বয়ংসম্পূর্ণ, সেই দেশ তত বেশি শক্তিশালী।

লেখক : কলামিস্ট ও সভাপতি, বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা।

   


পাঠকের মন্তব্য