বাংলাদেশে নির্বাচনের অন্ধকার দিক ও যুক্তরাষ্ট্র

জেনারেল জিয়াউর রহমান

জেনারেল জিয়াউর রহমান

ইন্ডিয়া টুডে; বিশ্লেষণ : বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাস সহিংসতার এবং অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শাসকদের ক্ষমতা দখলের। দেশের সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় এখন আগামী ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচন। কোন পক্ষ বিজয়ী হবে সেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছে এখন সবাই তাকিয়ে।

১৯৭৭ সালের ৩০ মে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো নির্বাচন জালিয়াতি হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এ ঘটনা মানুষের স্মৃতি থেকে সহজে মুছে যাওয়ার নয়। সেসময় দেশের প্রথম গণভোটে ফলাফল কারচুপি করে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীদের একজন এবং তৎকালীন সেনাপ্রধান নিজের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা হাসিল করেছিলেন।

উচ্চাভিলাষী জেনারেল জিয়াউর রহমান আক্ষরিক অর্থেই সামরিক উর্দি পড়ে নেতৃত্ব দিয়ে নিজেই সার্ভিস আইন লঙ্ঘন করেছিলেন। পরে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেছিলেন। সার্ভিস আইনে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের নির্বাচনে অংশ নেয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তবুও, গণতন্ত্রের স্বঘোষিত বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনও উদ্বেগ বা সতর্কতা আসেনি, বরং নির্লজ্জভাবে জেনারেল জিয়ার পক্ষ নিয়েছিল এবং নজিরবিহীনভাবে ঘটে যাওয়া অনিয়মগুলোকে অবলীলায় উপেক্ষা করেছিল।

এইভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভণ্ডামির দীর্ঘ ঐতিহ্যে একটি নতুন অধ্যায় যুক্ত হয়েছিল। বরং এটি ছিল এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ ঐতিহ্যের এক নতুন অধ্যায়।

সামরিক শাসকদের বিদায় নেয়া এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসার সুবাদে যুগের পর যুগ পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন পরিপক্ক একটি দেশ। এ পরিস্থিতিতে ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘোষণা সেই বাস্তবতাকেই সামনে নিয়ে আসে। গত মাসে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছেন, যেখানে বলা হয় যারা ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবে না।

গবেষকরা বলে থাকেন, কয়েক দশক ধরে সেসব ‘সামরিক স্বৈরশাসকদেরই’ যুক্তরাষ্ট্র বুকে আগলে ধরেছে যারা ‘স্বৈরাচার বা পাকিস্তানি কায়দায় সামরিক শাসনের’ সংস্কৃতি চালু করেছিল। গবেষক অজয় দাস গুপ্ত বলেন, ‘এই দেশের জন্ম ঠেকানোর চেষ্টা থেকে শুরু করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে গণহত্যা চালানোর সুযোগ করে দিতে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন। তখনকার সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পাকিস্তানী-কায়দার একটি সামরিক শাসনই চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।’

স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের একটি অংশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যোগসাজশ করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে, যারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের ১৯ সদস্যসহ গুলি করে হত্যা করে। তারপর কয়েক দশক পেরিয়ে গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানোর আহ্বান জানিয়ে আসছেন। কিন্তু যুত্তরাষ্ট্র সাড়া দেয়নি। রাশেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত।

অনুসন্ধানী সাংবাদিক এবং ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউয়ের সাবেক দক্ষিণ এশিয়া সংবাদদাতা লরেন্স লিফশুল্টজ মনে করেন, জিয়ার সমর্থন ছাড়া এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে থাকা ব্যক্তিরা পালিয়ে যেতে পারতো না। তিনি আরও বলেন, আমেরিকার সমর্থন ছাড়া জিয়াও এ কাজ করতে পারতেন না।

২০০৬ সাল থেকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশটি পরিচালনায় সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা উল্লেখ করে পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, ‘তখন দেশটি বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের খেলার মাঠে পরিণত হয়েছিল। শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে দুর্নীতির বানোয়াট কাহিনী ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ার পর শীর্ষ নেতাদের কারারুদ্ধ করা হয়।’

‘সংবিধান বহির্ভূত কিংবা অসাংবিধানিকভাবে গড়ে উঠা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারণে বাংলাদেশ বিদেশি কূটকৌশলের খেলার মাঠে পরিণত হয়েছিল, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে চরমভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। এ ঘটনা পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারকে সংসদে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যবহারের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে।’

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের। তিনি বলেন, ‘নেতৃস্থানীয় গণতান্ত্রিক পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারত যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশও তা যুক্তিযুক্তভাবেই পারে।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন সাবেক উপদেষ্টা মন্তব্য করেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে পারে না, যদি তা স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে।’

সেসময় প্রথম আলো এবং দ্য ডেইলি স্টার-সহ দেশের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমকে অপব্যবহার করা হয়েছিল, যারা ‘অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়েছিল এবং এমনকি বিরাজনীতিকরণের জন্য সম্পাদকীয় অবস্থানও নিয়েছিল।’ যাইহোক, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মুখে এই সব ষড়যন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে।

সেই বিজয়ের পর, বাংলাদেশে দুটি জাতীয় নির্বাচন হয়, যার প্রথমটি ২০১৪ সালেেএবং দ্বিতীয়টি ২০১৮ সালে।

২০১৪ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জামায়াত ভোট বর্জন করে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে নির্বাচন বানচালের উদ্দেশ্যে দল দুটি যানবাহনে ভয়াবহ আগুন সন্ত্রাস-বোমা হামলা চালায়। জামায়াত সারাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালায়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রণব পান্ডে সহিংসতার বিষয়ে বলেন, ‘নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার দায়িত্ব অবশ্যই ক্ষমতাসীনদের, কিন্তু বিরোধীরা যদি নির্বাচন বর্জন এবং সহিংসতা বন্ধ না করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকে, তাহলে কী হতে পারে? সরকার কি করবে? বিএনপির জন্য নির্বাচন বর্জন কৌশলগত ভুল ছিল।’

২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নির্বাচন সম্পর্কে অভিযোগের বিষয়ে নবনিতা চৌধুরী বলেন যে, ‘ভোট কারচুপির কোনও প্রমাণ বিরোধী দলের কেউ দেখাতে পারেনি।’ নবনিতা নেতৃস্থানীয় জাতীয় গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করেন।

ভোটে ‘অনিয়ম’ নিয়ে বিরোধীদের বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, ‘টক-শোতে, এই ধরনের অভিযোগ সম্পর্কে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কিন্তু বিরোধী নেতারা তাদের দাবির স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেননি।’ তাছাড়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে গণমাধ্যমে বেশ কয়েকজন বিরোধী নেতাকে ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে দেখা গেছে এবং ভোট প্রদান শেষে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে গণমাধ্যমে ব্রিফ করেন। তবে ভোট শেষ হওয়ার পর তারা সুর পাল্টে ফেলেন।

২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার দায়ে দোষী সাব্যস্ত তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় বসানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনবে বলে এখন ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। তারেক রহমান ২০০৮ সাল থেকে সপরিবারে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। তারেক রহমানের আগমন এবং তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়ে বিরোধী দলের নেতারা দেশজুড়ে সহিংসতার ভীতি ছড়িয়ে দিয়েছে।

আশ্চর্যের কিছু নয় যে প্রধানমন্ত্রীকে কেন প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিয়েছে বিএনপি নেতারা, যা ১৯৭৫ সালের তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার পুনরাবৃত্তিকেই ইঙ্গিত করে। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের অফিসে হামলা এবং “সর্ব শক্তি দিয়ে আন্দোলন” চালিয়ে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার হুমকি- এসবই এমন কিছু লক্ষণ যা ইঙ্গিত করে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ পদক্ষেপ হয়তো বিরোধী দলকে আলোচনার টেবিলে বসানোর ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে।

   


পাঠকের মন্তব্য