বিদেশি প্রভু নয়, জনগণই হোক সকল ক্ষমতার উৎস

কলামিস্ট প্রভাষ আমিন

কলামিস্ট প্রভাষ আমিন

প্রভাষ আমিন : স্টকটন রাশ যেভাবে রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে খেলনা সাবমেরিন ডুবিয়ে দেয়; বিশ্ব মোড়লরা তেমনি বাংলাদেশকে নিয়ে খেলছেন৷ রাজনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বাংলাদেশ যেন বিশ্বের বাঘা বাঘা খেলোয়াড়দের খেলার মাঠ৷ পশ্চিমাদের খেলাধুলা আমাদের জন্য ডেকে আনে মরণ দশা৷

শতবছর আগে ডুবে যাওয়া টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়ে আটলান্টিকে সলিল সমাধি ঘটেছে ডুবোযান টাইটানের পাঁচ যাত্রীর৷ প্রতিটি মানুষের প্রাণই অমূল্য৷ কারণ বিজ্ঞান অনেককিছু আবিষ্কার করলেও মানুষকে প্রাণ দেয়ার ক্ষমতা বা অমরত্বের সূত্র আবিষ্কার করতে পারেননি৷ কিন্তু টাইটানের সাথে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পাঁচটি প্রাণই একটু বেশি ‘দামি'৷ কারণ পাঁচজনই মৃত্যুর সময় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার রেখে গেছেন, যা তাদের মৃত্যুর সময় কোনো কাজেই আসেনি৷ এই অনন্ত যাত্রার জন্য একেকজনকে গুনতে হয়েছে বাংলাদেশি টাকায় আড়াই কোটি টাকা৷ টাইটানের পাঁচ যাত্রীর সাথে ছিলেন একজন চালক৷ তবে যিনি চালক, তিনিও নিছক চালক নন; ওশানগেট কোম্পানির মালিক স্টকটন রাশ৷ আটলান্টিকের নিচে পানির প্রচণ্ড চাপে বিস্ফোরিত হওয়ার পর এখন টাইটানের নিরাপত্তার নানা দিক নিয়ে কথা হচ্ছে৷ 

ওশানগেটের সিইও স্টকটন রাশ সবাইকে বলতেন, এটা রাস্তা পার হওয়ার মতই নিরাপদ৷ কিস্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ব্যাপারটি তেমন নয় মোটেই৷ অ্যাডভেঞ্চারাস রাশ নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় না রেখে স্রেফ কম্পিউটার গেমস খেলার রিমোট কন্ট্রোলের ওপর ভরসা করে চারজন মানুষ সাথে নিয়ে ডুব দিয়েছিলেন আটলান্টিকে৷

ব্যাপারটি যে কম্পিউটার গেমসের মত ছেলেখেলা নয়, এটা বিশ্ব বুঝেছে, পাঁচজন মানুষের জীবনের বিনিময়ে৷ কাজী নজরুলের একটা গান আছে না, ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে…'৷ টাইটানের এই অনন্তযাত্রা যেন তেমনই এক ছেলেখেলা৷ আমার লেখার বিষয় বাংলাদেশের রাজনীতি৷ এই বিষয়ের সাথে টাইটানের ডুবে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই৷ কিন্তু টাইটানের ডুবে যাওয়া বিশেষ করে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বাবা-ছেলের একসাথে মরে যাওয়ার বিষয়টি কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছি না৷ বাবা শাহজাদা দাউদ অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় হলেও ১৯ বছর বয়সি ছেলে সুলেমান দাউদ ততটা ছিলেন না৷ তিনি এই ঝুঁকিটা যেতে চাননি৷ টাইটানের নিরাপত্তা নিয়েও তার প্রশ্ন ছিল৷ কিন্তু বাবা দিবসে বাবার আবদার ফেলতে পারেননি ছেলে সুলেমান৷ কিন্তু আমি ভাবছি, চোখের সামনে ছেলে মরে যাচ্ছে, এটা কীভাবে সহ্য করেছেন শাহজাদা দাউদ৷ নদী রচনা মুখস্ত করে আসা ছাত্র যেভাবে গরুকে নদীর পাড়ে নিয়ে যায়, আমিও তেমনি খেলনা সাবমেরিন টাইটানকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এনে ডোবাবো৷ বিরাট শিশু যেভাবে বিশ্ব লয়ে খেলে, স্টকটন রাশ যেভাবে রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে খেলনা সাবমেরিন ডুবিয়ে দেয়; বিশ্ব মোড়লরা তেমনি বাংলাদেশকে নিয়ে খেলছেন৷ ভূ-রাজনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বাংলাদেশ যেন বিশ্বের বাঘা বাঘা খেলোয়াড়দের খেলার মাঠ৷ পাড়ে দাড়িয়ে পুকুরে ঢিল ছোঁড়াটা শিশুদের জন্য খেলা৷ কিন্তু পুকুরে থাকা ব্যাঙের জন্য তা মরণ৷ তেমনি পশ্চিমাদের খেলাধুলা আমাদের জন্য ডেকে আনে মরণ দশা৷

নিজেদের ঘরের ঝগড়া নিজেরা মিটিয়ে ফেলতে পারলেই সবচেয়ে ভালো৷ বাইরের কাউকে যখন আপনি ডেকে আনবেন, তিনি আপনার ভালো চাইবেন না৷ ডেকে আনার আগে নিশ্চিত হয়ে নিন, যাকে ডেকে আনছেন তিনি আপনার বন্ধু কিনা, নাকি বন্ধুর মুখোশধারী শত্রু ভয়ঙ্কর৷ বাংলাদেশ তার জন্মের সময়েই আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছিল৷ মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের পাশে ছিল সর্বাত্মকভাবে৷ শেষ পর্যন্ত ভারত সরাসরি পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধেও জড়িয়েছিল৷ মুক্তিযুদ্ধে তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পাশে ছিল৷ সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে দুইবার তার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ না করলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতে পারতো৷ আর একাত্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি পাকিস্তানের গণহত্যার পক্ষে মানে বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল৷ আজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মূল প্রতিপক্ষ চীনও একাত্তরে তাদের পাশেই ছিল৷ 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র৷ বাংলাদেশের জন্ম তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে৷ এই ব্যর্থতার গ্লানি তারা ভুলতে পারেনি৷ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় ৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের জন্যও দায় আছে যুক্তরাষ্ট্রের৷ ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের সাথেও যোগসূত্র ছিল যুক্তরাষ্ট্রের৷ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘ সময় দেশ চালিয়েছে সামরিক শাসকেরা৷ দীর্ঘ আন্দোলনে সামরিক শাসনের অবসান ঘটলেও পুরোপুরি জনগণের শাসন পাইনি আমরা৷

দীর্ঘদিন খাঁচায় বন্দি কোনো পাখির খাঁচা খুলে দিলেও সে উড়ে যায় না৷ উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে খাঁচার কাছেই থাকে৷ আমাদের অবস্থাও হয়েছে তেমনই৷ ব্রিটিশদের অধীনে দুইশো বছর শাসিত হওয়ার স্মৃতি রয়ে গেছে আমাদের চেতনার গহীনে৷ এখনও সাদা চামড়ার মানুষ দেখলেই আমরা তাদের প্রভু মানি, মনের অজান্তেই নত হয়ে যাই আমরা৷ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বিদেশি সাহায্য আমাদের দরকার ছিল৷ সামরিক শাসনের আমলেও সহায়তানির্ভর ছিল আমাদের অর্থনীতি৷ আস্তে আস্তে আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, জিডিপি বেড়েছে৷ কিন্তু নতজানু মানসিকতা বদলায়নি৷ বিদেশি কূটনীতিকরা বাংলাদেশে রীতিমত সেলিব্রেটি৷ বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত, ব্রিটিশ হাইকমিশনার বা ভারতীয় হাইকমিশনারের নাম সবাই জানে৷ তারা যাই বলেন, গণমাধ্যম তা অতি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে৷ নিজেদের এই ভিআইপি মর্যাদাটা তারাও জানেন৷ তাই কারণে-অকারণে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলেন৷ এমনকি কূটনৈতিক সীমা লঙ্ঘন করেও তারা সবকিছুতে নাক গলান৷ আমরা নিজেদের সুবিধামত স্বাগত জানাই বা প্রতিবাদ করি৷

মানুষ সামাজিক জীব৷ বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে আমাদের চলতে হয়৷ কিন্তু যত ভালো বন্ধুই হোক, কেউ আমাদের ঘরের বিষয়ে নাক গলালে আমরা সেটা পছন্দ করি না, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোনো মানুষই সেটা পছন্দ করবে না৷ দেশের ক্ষেত্রেও বিষয়টা তেমনই হওয়া উচিত৷ বিশ্বে আমরা একা চলতে পারব না৷ আমাদের বন্ধু থাকবে৷ আমরা সবাই মিলে-মিশে থাকব৷ কিন্তু বন্ধুত্বের সীমা লঙ্ঘন করে কেউ কেউ প্রভু বনে যান৷ আর আমরা সেটা মেনেও নেই৷ মুখে আমরা বলি বটে, বিদেশে আমাদের বন্ধু আছে, প্রভু নেই৷ কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন৷ প্রভূদের সামনে আমরা নত হয়ে থাকি৷ এই মানসিকতা বিশেষ কোনো দলের নয়৷ সব দলই নিজেদের সুবিধামত প্রভু বেছে নেয়৷

১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান স্টিফেন৷ ২০০১ সালে এসেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার৷ ২০১৩ সালে এসেছিলেন জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো৷ তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করেছেন, সমঝোতার চেষ্টা করেছেন৷

কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছেন৷ বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম আলোচিত অধ্যায়ের একটি এক এগারো এর সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার৷ অস্বাভাবিক এই সরকারের আসল কুশিলব ছিলেন বিদেশি কূটনীতিকরা৷ বিশেষ করে তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রেসিয়া বিউটেনিস, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রেনেটা লক ডেসেলিয়ান দুতিয়ালী করে ২০০৭ সালের তদারক সরকার এনেছিলেন৷

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি গালি হলো ভারতের দালাল আর পাকিস্তানের দালাল৷ এক পক্ষ আরেকপক্ষকে দালাল বলে গালি দেন৷ আসলে সব দলই কোনো না কোনো দেশের দালালি করে৷ একসময় বাংলাদেশের রাজনীতির জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘রুশ-ভারতের দালালেরা হুশিয়ার সাবধান‘,'মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ-নিপাত যাক, নিপাত যাক'৷ একসময় বলা হতো, বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা মস্কোতে বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরে৷ তবে সব কমিউনিস্ট আবার মস্কোপন্থি ছিলেন না৷ কিছু ছিলেন পিকিংপন্থি৷ চীন-রাশিয়ার মধ্যে যতটা না দ্বন্দ্ব ছিল, বাংলাদশে মস্কোপন্থি, পিকিংপন্থি কমিউনিস্টদের মধ্যে আদর্শিক লড়াই ছিল তারচেয়েও বেশি৷ তবে সময়ের সাথে সাথে আমাদের রাজনৈতিক কেবলাও বদলে যায়৷ একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্র-চীন এক কাতারে দাড়িয়ে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে৷ এখন যুক্তরাষ্ট্র আর চীন প্রধান বাণিজ্যিক প্রতিপক্ষ৷

যুক্তরাষ্ট্র তাই বাংলাদেশকে ধমক দিলে চীন পাশে দাড়িয়ে যায়৷ রাজনীতিতে নাক গলানোর জন্য বাংলাদেশ এতটাই সহজগম্য, জাপানের মত রাজনীতিনিরপেক্ষ দেশের রাষ্ট্রদূতও আমাদের নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন৷

সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্রের অনেক সমস্যা আছে৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভুল কাউকে বেছে নিলেও সেটা মেনে নিতে হয়৷ আবার ধরুন, কোনো এক নির্বাচনে পাঁচজন প্রার্থী৷ একজন পেলেন ৩০ ভাগ ভোট৷ বাকি চারজন মিলে পেলেন ৭০ ভাগ ভোট৷ এককভাবে ৩০ ভাগ ভোট পাওয়া ব্যক্তিটিই কিন্তু নির্বাচিত হবেন৷ তার মানে ৭০ ভাগ মানুষ যার বিপক্ষে, তিনিই কিন্তু নির্বাচিত হয়ে গেলেন৷ কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামে এক স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সব প্রার্থীরই জামানত বাজেয়াপ্ত হলো৷ কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া ব্যক্তি নির্বাচিত হলেন৷ তারমানে জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া ব্যক্তিই হলেন জনপ্রতিনিধি৷ এতকিছুর পরও গণতন্ত্রের চেয়ে ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই৷ সমস্যা হলো, আমরা মুখে বলি বটে, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস৷ কিন্তু অন্তরে বিশ্বাস করি না৷ আমরা চেয়ে থাকি বিদেশি প্রভুদের দিকে৷ কাগজে-কলমে নির্বাচন হয় বটে৷ কিন্তু ক্ষমতা নির্ধারণে জনগণ কতটা ভূমিকা রাখেন, তা নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে৷ এমনকি পাশের দেশের পররাষ্ট্র সচিবও আমাদের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন৷ আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে ভারতের সাহায্য চান৷ সেটা আবার ঘটা করে বলেনও৷

নানা কারণে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের আগের দুটি নির্বাচন ভালো হয়নি৷ একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন তাই বাংলাদেশের জনগণের সার্বজনীন আকাঙ্খায় পরিণত হয়েছে৷ কিন্তু সে আকাঙ্খার বাস্তবায়নে জনগণের ভূমিকা যেন সামান্যই৷ বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের বিদেশিদের ব্যস্ততা বেশি৷ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, রাশিয়া, ভারতের নানান তৎপরতার দিকে যেন চেয়ে আছে সবাই৷ এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর যুক্তরাষ্ট্র সফরও বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে৷ বিএনপি অনেকদিন ধরেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে৷ কিন্তু সেই দাবি আদায়ে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর যতটা চাপ দেয়া দরকার, ততটা চাপ তারা কখনোই দিতে পারেনি৷ আমরা জানি এবং দেখে আসছি; দাবি আদায়ে জনগণকে সাথে নিয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়৷ কিন্তু বিএনপি তাদের দাবির পক্ষে জনগণকে কখনোই কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করতে পারেনি৷ নির্বাচনের বাকি মাত্র ছয় মাস৷ তফশিল ঘোষণার সময় আমলে নিলে আর মাস চারেক সময়

আছে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে অচলাবস্থা নিরসনের৷ কিন্তু বিএনপির লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে না, তারা দাবি আদায় করার মত আন্দোলন করার জন্য তৈরি বা আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করতে চায় তারা৷ বরং মনে হচ্ছে, তারা বিদেশি কোনো প্রভুর দিকে তাকিয়ে আছে,যারা চাপ দিয়ে সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করে দেবে৷ জনগণের কাছে যাওয়ার চেয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বিদেশিদের কাছে ধরনা দিতেই বেশি ব্যস্ত৷ কূটনীতিকদের কাছে দৌড়ঝাঁপ তো আছেই, লবিং করতেও ক্লান্তি নেই৷ এটা ঠিক বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রত্যাশিত মানে নেই৷ কিন্তু সেটা যদি আমরা নিজেরা দাবি করে, চাপ দিয়ে, আন্দোলন করে ঠিক করতে পারতাম, তাহলেই সবচেয়ে ভালো হতো৷ সেটা আমরা পারিনি৷ তাই মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে র‌্যাব কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা লাগে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি রাতারাতি বদলে দিয়েছে নির্বাচনের মান ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ভারতে ক্ষমতা পরিবর্তন হলে আশায় বুক বাধেন৷ মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, ভিসা নীতি বা কংগ্রেসম্যানদের চিঠিকে নিজেদের সাফল্য ভেবে উল্লাস করেন৷ শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের সদস্য না নিতে জাতিসংঘে লবিং করেন৷

অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে গত ৫২ বছরে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে৷ অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের মনোজগতে পরিবর্তন আনাটা জরুরি৷ ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে৷ আত্মমর্যাদা না থাকলে সব উন্নয়নই অর্থহীন হয়ে যাবে৷ বিদেশে আমাদের বন্ধু থাকবে, প্রভু নয়; এটা যেন সবাই মন থেকে বিশ্বাস করেন৷ বন্ধুরা আমাদের পরামর্শ দেবেন, কিন্তু কিছুই চাপিয়ে দেবেন না৷ বাংলাদেশের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশের জনগণ, আর কেউ নন৷ আমাদের সবগুলো রা্জনৈতিক দল যদি মন থেকে এটা মেনে নেন, তাহলেই কেবল এটা বাস্তবায়ন সম্ভব৷ তবে তার আগে রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের শক্তি সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হতে হবে৷ উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণআন্দোলন সফল হয়েছিল, কারণ জনগণের সর্বাত্মক সমর্থন ছিল৷ এমনকি বর্তমান সরকারের আমলেও কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের আন্দোলন, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন, গণজাগরণ মঞ্চ সফল হয়েছে জনগণের সমর্থন ছিল বলেই৷ জনগণের সমর্থন না থাকলে যে কিছুই অর্জন করা যায় না, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর৷ 

জাসদের বিপ্লব ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল, কারণ জাসদ শহীদ মিনারের সামনে প্রত্যাশিত জনসমাবেশ করতে পারেনি৷ জনসমর্থন ছিল না বলেই এক এগারোর সরকারও প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌছতে পারেনি৷ তাই আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি মন থেকে বিশ্বাস করেন, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এবং দেশের যেকোনো সমস্যায়, সঙ্কটে জনগণকে সাথে নিয়ে মাঠে নামেন; বিদেশিদের দিকে চেয়ে না থাকেন; তাহলেই বাংলাদেশের সত্যিকারের উন্নয়ন হবে৷ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা নিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। 

   


পাঠকের মন্তব্য