গণতন্ত্র হচ্ছে মুক্তির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ | প্রজন্মকণ্ঠ 

গণতন্ত্র হচ্ছে মুক্তির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ

গণতন্ত্র হচ্ছে মুক্তির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ

রাষ্ট্রদর্শনের মূল সূত্রের প্রণেতা প্লেটো ও এরিস্টটল গণতন্ত্রকে উত্তম শাসনব্যবস্থা না বললেও সময়ের পরিবর্তনে গণতন্ত্র আজ অধিকাংশ দেশে একটি গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা। বিভিন্ন যুগে গণতান্ত্রিক আদর্শের চর্চা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সন্ধান পাওয়া গেলেও আধুনিক যুগেই তা স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করে।

আধুনিক রাষ্ট্রদার্শনিকেরা, যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন লক, রুশো, বেন্থাম, মিল, জেফোরসন, ডিউই, রলস, মার্কস প্রমুখ গণতন্ত্রকে একটি রাষ্ট্রদার্শনিক ও নীতিদার্শনিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। গণতন্ত্রের মূল চেতনা জনগণের কল্যাণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠা।

গণতন্ত্র হলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া। আমাদের দেশের গণতন্ত্রের প্রকৃতি, কারণ ও পরিণতি নিয়ে তেমন দার্শনিক আলোচনা দেখা যায় না। যে-কারণে গণতান্ত্রিক ধারণা মানুষের কাছে পরিষ্কার নয়। 

এখানে গণতন্ত্রের চর্চায় নির্বাচন-ভিত্তিক শাসন-ব্যবস্থাকেই গণতন্ত্র বলার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু গণতন্ত্র মানে শুধুমাত্র সুষ্ঠু নির্বাচন নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনসাধারণই রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বে সার্বভৌমত্ব অর্জন করে এবং জনগণ নিজেদের স্বার্থে সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। কাজেই নির্বাচন শুধুমাত্র ক্ষমতা পরিবর্তনের হাতিয়ার ছাড়া আর কোনো মাত্রা যোগ করতে পারে না। তবে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ভূমিকা রাখতে পারে দেশের নাগরিক-সমাজ ও বিজ্ঞজনদের মতামত। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে প্রত্যেক রাজনীতিবিদ ও সরকার নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে।

গণতন্ত্রের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় সার্বজনীন স্বাধীনতা, প্রগতিশীল ও আলোকিত জনগণের অভিমত প্রকাশের সুযোগ। গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সমাজের সকল মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তি-মানুষের সক্রিয় ভূমিকা অপরিহার্য।

গণতন্ত্র কেবলমাত্র একটি বিশেষ ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা নয়। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র বলতে আরও ব্যাপকতর ও গভীরতর আদর্শকে বোঝায়। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে যেসব আদর্শ গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে অন্যতম হলো স্বাধীনতা, সাম্য, মানবাধিকার, জনমত, সুশাসন, নৈতিকতা ইত্যাদি।

মার্কসবাদ ও লেলিনবাদের ওপর ভিত্তি করে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজতন্ত্র হলো মেহনতি মানুষের গণতন্ত্র। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতিক্রিয়া হিসেবে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের উদ্ভব হয়। অতি সাম্প্রতিককালে (১৯৯০ সাল পরবর্তী পর্যায়ে) উদারনৈতিক ব্যবস্থাই সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা রূপে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে স্বীকৃত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ভারত, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে উদারনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। জনসাধারণের অধিকার, স্বাধীনতা, স্বতঃস্ফূর্ততা, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি সম্পর্কে সরকারের উদার মনোভাব এবং অহেতুক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা থেকে নিজেকে বিরত থাকা উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

বাংলাদেশের সংবিধান কেবলমাত্র একটি পুস্তুক বা দলিল নয়। এটিকে বলা যায় বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রা রাষ্ট্রের নাগরিক ও সাধারণ মানুষের জীবনের সংক্ষিপ্ত প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’, ‘প্রজাতন্ত্র’ এবং ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ এই তিনটি অধ্যায়ের মধ্যে যেসব আকাক্সক্ষা ব্যক্ত রয়েছে সংবিধানের মৌল ক্ষমতা-কাঠামোকে যদি তা বাস্তবায়নের উপযোগী করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের সংবিধান অবশ্যই পৃথিবীতে ‘গণতান্ত্রিক সংবিধান’-এর একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশে কেউ কেউ গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুবই আশাবাদী। আবার কেউ কেউ নৈরাশ্য প্রকাশ করে। তবে যে কথাটি আমাদের স্মরণ রাখা প্রয়োজন তা হলো, প্রত্যেক জাতিকে নিজের গণতন্ত্রকে নিজে জেনে নিতে হবে। গণতন্ত্র কেউ কাউকে দান করতে পারে না। গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থায় জনগণ দর্শক নয়, বরং জুরি। তারা সাক্ষ্য-প্রমাণের শুনানি গ্রহণ করেন এবং নির্বাচনের দিন ভোটের মাধ্যমে তাদের রায় দেন।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনুসন্ধান ও সমালোচনার অধিকার, প্রগতি ও উপলব্ধির দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। সামাজিক বৈষম্য ও অসমতাই সামাজিক সংকটের মূল কারণ। মানুষ স্বাধীনতা, মানবিকতা ও মানব মুক্তির নৈতিকতার ধারণা নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। গণতন্ত্রের অর্থ মুক্তি থেকে ব্যাপক। এতে থাকে বাস্তব কর্মপদ্ধতি। গণতন্ত্র হচ্ছে মুক্তির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। মুক্ত থাকার জন্যই প্রয়োজন গণতন্ত্র। সকল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নাগরিকেরা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে থাকে। তবে উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে যথার্থ আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে, যার ভিত্তিতে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তা সত্ত্বেও উদারনৈতিক গণতন্ত্র পুঁজিবাদী অর্থনীতির রাজনৈতিক রূপ বিধায় সংকট থেকেই যায়। 

এ সংকট থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। কাজেই রাষ্ট্রীয় কাঠামো এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে গণতান্ত্রিক মূলবোধকে দেশের সকল নাগরিক বাধাহীনভাবে চর্চা করতে পারে। জনগণ যাতে রাষ্ট্রীয় কর্মকা-কে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেই উপযোগী করে তৈরি করতে হবে। তাহলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্রের সুষ্ঠু, সুন্দর ও সর্বজনীন বিকাশের মধ্যেই রয়েছে আগামী দিনের বাংলাদেশের সুন্দর ভবিষ্যৎ।

   


পাঠকের মন্তব্য