সবচেয়ে বেশি ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে 

প্রোপাগান্ডা ও বানোয়াট অপতথ্য ছড়ানোর প্রবণতা

প্রোপাগান্ডা ও বানোয়াট অপতথ্য ছড়ানোর প্রবণতা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভোট ও রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় ধরে প্রোপাগান্ডা ও বানোয়াট অপতথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। আগামী কয়েক মাসে এটি আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন পরিস্থিতি অপতথ্য মোকাবেলায় ফ্যাক্ট চেকার, মূলধারার গণমাধ্যম এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে বলে মত দিয়েছেন তারা।

কোনো দেশের জাতীয় নির্বাচন বা বিশেষ পরিস্থিতিতে সামাজিক মাধ্যমে অপতথ্য কিংবা গুজব ছড়ানোর বিষয়টি নতুন কিছু নয়। এর আগে ভারতের জাতীয় নির্বাচন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও এই প্রবণতা ব্যাপকভাবে দেখা গেছে। বাংলাদেশেও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে গুজব ছড়ানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। তবে এবার নির্বাচনের আগে এই প্রবণতা অতিমাত্রায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এক বছরে ছড়িয়েছে দেড় হাজার গুজব

রিউমার স্ক্যানার নামের একটি সংগঠন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব-অপতথ্য শনাক্তে কাজ করে। সংগঠনটির পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক বছরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদ মাধ্যম মিলে প্রায় দেড় হাজার গুজব ছড়ানো হয়েছে।

জুলাই-আগস্টে ৪৪.৪% রাজনৈতিক গুজব

অন্যদিকে অনলাইন যাচাই ও মিডিয়া গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ডিসমিসল্যাবের মতেও দেশে নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে অনলাইনে অপতথ্য, গুজব তত বাড়ছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়ই সবচেয়ে বেশি।

ডিসমিসল্যাবের হিসাবে গত জুলাই থেকে আগস্টের ২০ তারিখ পর্যন্ত যত মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে, তার ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশই হচ্ছে রাজনীতিবিষয়ক। এই সময়ে ছড়ানো মিথ্যা বা অপতথ্যের মধ্যে ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ স্থানীয়, যার মধ্যে ৫৮ দশমিক ৫ শতাংশ রাজনৈতিক।

রাজনীতিবিদদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে। এছাড়া একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যু ঘিরেও প্রচুর অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে।

সংসদ নির্বাচন ঘিরে যত গুজব

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের বরাতে ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন করাতে ব্যর্থ হলে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে ভারতের মতো সাম্প্রদায়িক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে’ বলে ফেসবুকে প্রচার করা হয়। এটিকে গুজব হিসেবে চিহ্নিত করেছে রিউমার স্ক্যানার টিম।

এছাড়া ‘আওয়ামী লীগ সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ডেডলাইন জানিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র’ শীর্ষক তথ্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়অ এটিকেও গুজব হিসেবে চিহ্নিত করে রিউমার স্ক্যানার। শুধু তাই নয় ‘অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ড. মুহাম্মদ ইউনূস’ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের এমন বক্তব্যও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হয়। এটিও গুজব বলে জানায় তথ্য যাচাইকারী সংস্থাটি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগের ঘোষণা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসছেন দাবিতে একাত্তর টিভির আদলে বানানো ভুয়া ফটোকার্ডও সম্প্রতি চিহ্নিত করে রিউমার স্ক্যানার।

সংস্থাটির ওয়েবসাইট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে গত জুলাই ও আগস্ট মাসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এমন প্রায় ২৪টি গুজব-অপতথ্য শনাক্ত করেছে তারা।

প্রয়োগ হচ্ছে এআই প্রযুক্তিরও

এত দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপতথ্য, গুজব, মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর বিভিন্ন নমুনা দেখা গেছে। এখন এর সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) প্রয়োগ। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কোনো একজনের মুখে অন্য কারও চেহারা বসিয়ে ছবির পাশাপাশি ভিডিও তৈরি করা হয়। অর্থাৎ ফটোশপের আরও আধুনিক সংস্করণ, যেটা ‘ডিপফেক’ নামে পরিচিত।

সম্প্রতি বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায়ও সেই ডিপফেকের শিকার হয়েছেন। ডিসমিসল্যাব জানায়, গত জুলাইয়ের শেষে ‘শ্রীকান্ত’ নামের ওয়েব সিরিজের একটি দৃশ্যে নায়িকা সোহিনী সরকারের চেহারায় নিপুণ রায়কে বসানো একটি রিল ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
একই ঘটনা ঘটেছে ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবালের ক্ষেত্রে। আগস্ট মাসের শুরুতে তাকে ছাত্রদলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপরই তার একটি ছবি নিয়ে এআই টুল ব্যবহার করে ভিডিও বানানো হয়। ডিসমিসল্যাব যাচাই করে জানিয়েছে, এটিও ডিপফেক।

ছড়াচ্ছে আরও রাজনৈতিক অপতথ্য

সম্প্রতি ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে মির্জা ফখরুল ৫০ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা নিয়েছেন’ এমন এক খবরের সঙ্গে একটি ভুয়া চেকের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। একাধিক ফ্যাক্ট চেকার বা তথ্য যাচাই নিয়ে কাজ করা সংস্থা এটিকে ভুয়া বলে জানায়।

এছাড়া ২৮ জুলাই গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে নারায়ণগঞ্জের এমপি শামীম ওসমানের দলীয় স্লোগানের একটি ভিডিও এডিট করে সেটিকে বিকৃতভাবে প্রচার করা হয়।

জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর পবিত্র কাবার ভেতরে তার প্রবেশের একটি ছবি ছড়ানো হয়। সেটিও ছিল এডিটেড ছবি। তার জানাজা নিয়েও একাধিক এডিটেড ছবি ছড়িয়ে পড়ে।

বাসে আগুন লাগানোর কথা স্বীকার করে এক কিশোর নিজেকে ছাত্রলীগের সদস্য দাবি করছে সম্প্রতি এমন একটি ভিডিও ছড়াতে দেখা যায়। তবে ভিডিওটি অন্তত চার বছর আগের। এর বাইরে, ‘বাসে আগুনের চেষ্টা, ছাত্রলীগের ৩ নেতা-কর্মী আটক’ শিরোনামে ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি সংবাদকে বিএনপির সাম্প্রতিক কর্মসূচির খবর বলে প্রচার করা হয়।

সমন্বিত মনিটরিং জরুরি

এএফপির ফ্যাক্টচেক সম্পাদক কদরুদ্দিন শিশির দৈনিক খোলাকাগজকে বলেন, ‘প্রথমত, নির্বাচনের আগে অনলাইনে গুজব/মিসইনফরমেশন (অপতথ্য) বা ডিসইনফরশেন (কুতথ্য) ছড়ানোর প্রবণতা বেড়ে যাওয়া বৈশি^কভাবেই রয়েছে। বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন দেশে এমনটি দেখা গেছে। বাংলাদেশে ২০১৮ সালের নির্বাচনেও এগুলো ছিল। তবে এবার মাত্রার দিক থেকে তা অনেক বেড়েছে। ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী উভয় রাজনৈতিক পক্ষেরই একে অন্যের বিপক্ষে গুজব ছড়ানোর প্রমাণ রয়েছে। এটা মূলত জনমত প্রভাবিত করার লড়াই। মূলধারার মিডিয়ার বাইরে সামাজিক মাধ্যম যেহেতু জনমত প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ টুল, ফলে রাজনৈতিক পক্ষগুলো এটি নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করতে চায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে তত এটি বাড়বে বলেই আমরা যারা অনলাইন স্পেস মনিটর করি তাদের অনুমান। বেশ কিছু ইন্ডিকেটর দেখা যাচ্ছে যে আগামী কয়েক মাস রাজনৈতিক অপতথ্য অনেক বেড়ে যাবে। অপতথ্য মোকাবেলায় ফ্যাক্ট চেকাররা কাজ করছেন। তবে আমার মনে হয় মূলধারার মিডিয়া যদি ফ্যাক্ট চেকারদের সাথে মিলে কাজ করে তাহলে গুজবের বিরুদ্ধে লড়াইটা কার্যকর হবে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি কোনো ধরনের পক্ষপাতমূলক আচরণ ছাড়া পেশাদারিত্বের সাথে অপতথ্য মোকাবেলায় কাজ করে তাহলে তাদের পক্ষ থেকে অপতথ্যের জন্য ক্যাম্পেইন খুবই কার্যকরী হতে পারে।’

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশে^র কাছে বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করতে স্বার্থানেষী মহল নানা গুজব ও অপপ্রচার চালাচ্ছে। এরা টার্গেটবেজ অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই গুজব সৃষ্টিকারীদের বিষয়ে র‌্যাবের সাইবার মনিটরিং সেল দায়িত্ব পালন করেছে।’

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের সিনিয়র পুলিশ সুপার মো. রেজাউল মাসুদ বলেন, ‘দেশে যারা ফেসবুকে গুজব ছড়াচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করতে পারলেও বেশিরভাগই বিদেশে বসে বিভিন্ন অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কেবল মেটা কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি তারা আশ্বস্ত করেছে যেসব আইডি থেকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে সেগুলো সরিয়ে নেবে।’

পাঠকের মন্তব্য