টেকনোলজিস্ট থেকে ডাক্তার কম্পাউন্ডার তারপর এমবিবিএস 

ভুয়া ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন ওরফে আরিফুল ইসলাম

ভুয়া ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন ওরফে আরিফুল ইসলাম

গত আড়াই বছর ধরে পরিচয় গোপন রেখে অন্যের নাম ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার করে বরিশালের গৌরনদী, আগৈলঝাড়া ও মুলাদী উপজেলার ৬টি বেসরকারী ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চেম্বার করে চিকিৎসাসেবার নামে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়েছে ভুয়া এমবিবিএস ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন ওরফে আরিফুল ইসলাম আরিফ।

এছাড়াও বিয়ের আশ্বাস দিয়ে এক নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ, প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়া, গ্রামের বাড়িতে মরিচ ব্যবসায়ীর মেয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে বিয়ে, ৪-৫টি নারী কেলেঙ্কারিসহ হাজারো প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে ভুয়া এমবিবিএস ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন ওরফে আরিফুল ইসলাম আরিফের বিরুদ্ধে। 

ভুয়া ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন ওরফে আরিফুল ইসলাম টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার সহবতপুর ইউনিয়নের হেরতা গ্রামের মৃত মোশারফ হোসেন ওরফে মো. আব্দুলের ছেলে। গত ৮-৯ বছর পূর্বে আরিফের বাবা মারা গেলে ঢাকার উত্তরায় গিয়ে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেকনোলজিস্ট ও এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কম্পাউন্ডার হিসেবে কাজ করতেন তিনি।

টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার সহবতপুর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. ইব্রাহিম মিয়া মোবাইল ফোনের ইমোতে পাঠানো ছবি দেখে জানান, আরিফের ৪-৫টি নারী কেলেঙ্কারি ও অনেক প্রতারণার ঘটনা গ্রামবাসীরা শুনেছেন। বর্তমানে কোটিপতির এক মেয়েকে বিয়ে করে আরিফ মাঝে মধ্যে বাড়িতে আসেন।

সহবতপুর ইউপির চেয়ারম্যান তোফাজ্জেল মোল্লা মোবাইল ফোনে জানান, তার ইউনিয়নের হেরতা গ্রামের মোহাম্মদ জাকির হোসেন এলাকায় টাউট ও প্রতারক নামে পরিচিত। এক মরিচ ব্যবসায়ীর মেয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে। পরে বিয়ে করতে না চাইলে গ্রাম্য এক সালিশ বৈঠকের মাধ্যমে আরিফের সঙ্গে ওই তরুণীকে বিয়ে দেওয়া হয়। এর কয়েক মাস পর ওই বিয়ে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। গত ৮-৯ বছর পূর্বে আরিফের বাবা মারা গেলে সে ঢাকার উত্তরায় গিয়ে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেকনোলজিস্ট ও এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কম্পাউন্ডার হিসেবে কাজ করার কথা আমরা শুনেছি।

এদিকে এক নারী চিকিৎসক লিখিত অভিযোগে জানান, গৌরনদীতে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আসা যাওয়ার সময় ডা. জাকির হোসেন তাকে প্রায়ই উত্ত্যক্তসহ প্রেম নিবেদন করে আসছিলেন। একপর্যায়ে ডা. জাকিরের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে ৮ মার্চ সকাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ২টি বাসাবাড়িসহ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তাকে (ওই নারী ডাক্তার) অসংখ্যবার ধর্ষণ করে ডা. জাকির হোসেন। বিয়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করলে জাকির তাকে বিয়ে করতে টালবাহানা করে আসছিলেন।

লিখিত অভিযোগে নারী ডাক্তার আরও জানান, গত ৮ মার্চ দিবাগত রাত ১১টার দিকে এক প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে অনৈতিক কাজের সময় স্থানীয়রা হাতেনাতে ডা. জাকিরকে আটক ও মারপিট করে। পরে মোবাইল ফোনে প্রভাবশালী ২-৩ ব্যক্তিকে ঘটনাস্থলে নিয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময় সেখান থেকে পার পেয়ে আসেন তিনি। আটকের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তখন ডা. জাকির তাকে বলেন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদটি মিথ্যা। এবং প্রতিবেদনকারীকে শায়েস্তা করার জন্য তার ছেলেকে মাদক দিয়ে ধরিয়ে দেয়ারও হুমকী দেয় সে। এরপর থেকে জাকির তাকে এড়িয়ে চলতে থাকেন। উপায়ন্তর না পেয়ে তিনি (নারী ডাক্তার) গত ২০ মার্চ রাত ১০টার দিকে টরকী বন্দর ফুড ভেলেজ রেস্তোরাঁয় গিয়ে প্রকাশ্যে ডা. জাকিরকে বিয়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। এ সময় ২-৩ বন্ধুর সহযোগিতায় সেখান থেকে ডা. জাকির সটকে পড়েন। পরদিন ২১ মার্চ সকালে ওই বন্ধুদের সহযোগিতায় টরকী বন্দর থেকে জাকির পালিয়ে যান।

প্রকৃত রেজিস্ট্রেশন নম্বরধারী ডা. মো. জাকির হোসেন বলেন, আমার বিএম এন্ড ডিসি রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও নাম-ঠিকানা ব্যবহার করায় ওই ভুয়া ডাক্তারের বিরুদ্ধে দিনাজপুর কোতোয়ালি থানায় একটি জিডি দায়ের করেছি। আমি দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অ্যানেস্থেশিয়া কোর্সে অধ্যায়নরত আছি। অভিযোগের বিষয়ে ভুয়া ডাক্তার মোহাম্মদ জাকির হোসেন ওরফে আরিফের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

গৌরনদী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মাজহারুল ইসলাম জানান, এ ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষ্যে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গৌরনদীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু আব্দুল্লাহ খান বলেন, আপনার কাছে এই প্রথম শুনলাম গৌরনদীতে এক ভুয়া এমবিবিএস ডাক্তার চেম্বার করে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গৌরনদী ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওহাব শিকদার বলেন, ভুয়া ডা. জাকির হোসেনের চেম্বার করার বিষয়টি আমি গত সপ্তাহে শোনার পর থেকেই তিনি উধাও হয়ে গেছেন। যেসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চেম্বার করতেন তাদের পক্ষে একজনকে বাদী হয়ে থানায় মামলা করতে বলা হয়েছে।

   


পাঠকের মন্তব্য