ড. মিস্ত্রির রিসার্চ ও সুন্দরবন দ্বীপপুঞ্জে জলবায়ু সংকট মোকাবেলা 

সুন্দরবন দ্বীপপুঞ্জে জলবায়ু সংকট মোকাবেলা 

সুন্দরবন দ্বীপপুঞ্জে জলবায়ু সংকট মোকাবেলা 

মধুসূদন মন্ডল, সাতক্ষীরা: আমেরিকার এমরি ইউনিভার্সিটির একজন সম্মানিত অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী ড. অবিনাশ চন্দ্র মিস্ত্রী, খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের কলবাড়ি গ্রামে সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জন্য আশার আলো হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। আন্তজার্তিক পরিমন্ডলে একজন গবেষক হিসেবে পেয়েছেন সুখ্যাতি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিদ্যা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার জন্য জাপান থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর মেধা ও গবেষণাকে আন্তজার্তিক পরিমন্ডলে প্রসারিত করতে তিনি আমেরিকার এমরি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র গবেষক রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট জেনেটিক এবং মোলিকুলার বায়োলজির একজন সম্মানিত অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী হিসেবে বাংলাদেশের সন্তান হিসেবে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতার শিখরে। তাঁর গবেষণার বিভিন্ন বিষয়বস্তু আন্তর্জাতিক জার্ণালে একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে। 

আমেরিকায় কর্মরত হয়েও ড. অবিনাশ চন্দ্র মিস্ত্রি বাংলাদেশ নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। তিনি তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু সফলভাবে আন্তর্জাতিক প্রসার বৃদ্ধির পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে চান। তিনি ও তাঁর গবেষণা টিম বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে তাঁর গবেষণায় আন্তজার্তিক বাজার মনিটরিং এ চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি এবং জলজ চাষের ল্যান্ডস্কেপকে রূপান্তরিত করা, লবন সহিষ্ণু কৃষিচাষ, সুন্দরবন, লোনাপানির মৎস্য, চিংড়ি ও কাঁকড়া গবেষণাসহ একইসাথে বায়ো-টেকনোলজি সমৃদ্ধ পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটাতে চান। গবেষণার পাশাপাশি অত্র অঞ্চলে শিল্পের প্রসার বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির একটি মডেল তিনি সারাবিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। তাঁর গবেষণায় প্রতিষ্ঠিত মডেলটি সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক বাজারে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, কৃষি ও জলজ চাষকে বায়োটেকনোলজিতে রুপান্তরিত করে আলোড়ন সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। হাই-টেক স্মার্ট ইন্টিগ্রেটেড এগ্রি অ্যান্ড অ্যাকোয়া ফার্ম প্রকল্প এবং হরিনা চিংড়ি চাষ সহ তার দূরদর্শী উদ্যোগগুলি এই অঞ্চলের কৃষি এবং জলজ চাষের ল্যান্ডস্কেপকে রূপান্তরিত করার জন্য প্রস্তুত করেছেন, যা অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং ক্ষমতায়নের অভূতপূর্ব সুযোগ নিয়ে আসবে অদূর ভবিষ্যতে। 

জলবায়ু পরিবর্তনে সারাবিশ্ব যখন টালমাটাল তখন গবেষণার বিষয়বস্তু জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলা। সারাবিশ্বে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া,জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়া,প্রাকৃতিক দূর্যোগ অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়া, তীব্র জলোচ্ছ্বাস,পরিবেশ দূষণ,সুপেয় পানির সংকট, নিরাপদ খাদ্য সংকট,সবুজায়ন কমে যাওয়া সহ আরো অনেক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। যার প্রত্যেকটি নেতিবাচক প্রভাবের সাথে বিশ্ব আবহাওয়া ও জলবায়ুরর পরিবর্তনে একে অপরের সাথে যোগসাজশ ভিন্ন মাত্রায় রুপ নিয়েছে।আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্রভাবে আসলেই  কি, কেন, কিভাবে দায়ী সেগুলো নিয়ে বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, গবেষক ও পরিবেশবিদরা দীর্ঘদিন থেকে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা পৃথিবীর সর্ববৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন সুরক্ষা যেমন গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে আন্তজার্তিক ফোরামে উঠে এসেছে তেমনি দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জনপদ সুরক্ষার বিষয়বস্তু গবেষণায় উঠে এসেছে।

ডঃ অবিনাশ চন্দ্র মিস্ত্রীর প্রচেষ্টা ভূমিভিত্তিক কৃষির বাইরে জলজ চাষের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বাংলাদেশের সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলে হরিনা চিংড়ি (মেটাপেনিয়াস মনোসেরোস) চাষের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। তিনি হরিণা চিংড়ি পোনা উৎপাদনের জন্য একটি হ্যাচারি এবং গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহন করেন, যার লক্ষ্য তার উচ্চতর গুণমান এবং বিশ্বব্যাপী বাজারের আধিপত্যের সম্ভাবনাকে পুঁজি করা।

বিশ্বমানের আধুনিক চিংড়ি শিল্প যার একটি উন্নত গবেষণা দল রয়েছে। এটি একটি সমন্বিত ফার্ম। সব ধরনের চিংড়ি, সামুদ্রিক মাছ, সামুদ্রিক শৈবাল, কোপেপড, মাইক্রো এবং ম্যাক্রো ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন। জুপ্লাঙ্কটন, একোয়ামিমিকেরী, বিওমিমিকেরী, RAS, বায়োফ্লক, বটম ক্লিন সিস্টেম, স্লাগ ম্যানেজমেন্ট, পূর্ণ জৈব নিরাপত্তা, শতভাগ ভেজালমুক্ত, অ্যান্টিবায়োটিক-মুক্ত, এবং GMO-মুক্ত, এবং উন্নত মুক্তা চাষ এবং সম্পর্কিত গবেষণা কাজ সব ধরনের উপর করা হবে। ফিড ইন্ডাস্ট্রিসহ সবজির চাষ করা হবে (ইনডোর ও আউটডোর) কিন্তু বাগদা ও কাঁকড়া আমাদেরকে অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। সেজন্য তিনি আমেরিকা থেকে বাংলাদেশের দিকে নজর দিয়েছেন আন্তজার্তিক পরিমন্ডলে এর প্রসার কিভাবে বৃদ্ধি করা যায়।

তাঁর গবেষণায় জানান, আমাদের বাংলাদেশের পানি, মাটি, তাপমাত্রা, আবহাওয়া ও জলবায়ু সবই অত্যন্ত অনুকলে আছে। তাঁর প্রতিষ্ঠানে পিএইচডি স্টুডেন্টরা গবেষনা করবে, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নিয়ে গবেষণা করবে।একই সাথে ড. মিস্ত্রি হরিণা চিংড়ির জেনেটিক রূপ তৈরি করে এবং বিশ্ব বাজারে একটি শক্তিশালী অবস্থান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভেনামির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার তার লক্ষ্যকে আরও বর্ণনা করেছেন।

হরিনা চিংড়ির জেনেটিক ভেরিয়েন্ট তৈরী করে ভেনামির সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে হরিনার জন‍্য বিশ্বমার্কেটে শক্ত অবস্থান করে নিতে চান। হরিনা স্বাদে ও গুনে ভেনামির চেয়ে অনেক ভালো। ভেনামির চেয়ে বড় ও হার্ডি লাইনার। ভেনামি ৩-৪ মাসে ৭০-৮০ পিস হয়, সেখানে হরিনা ২-২.৫ মাসে ৬০-৭০ পিস হয়। দামে হরিনা চিংড়ী ভেনামির চেয়েও বেশী।এসকল অঞ্চলগুলোতে লোনা পানি না ঢুকিয়ে সনাতন,সমন্বিত ও নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করা যায় কিনা এবং বৈশ্বিক চাহিদার সাথে অধিক পরিমাণে লাভজনক করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন টিমটি।

তিনি ভেনামির ব্যাপক চাষের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিলেন- কিন্তু ভয়ের বিষয় হল এই ভেনামি সর্বত্র চাষ করা ঠিক নয়। এই আমেরিকান ভেনামি যদি আমাদের নদীতে চলে যায়, তাহলে আমাদের হরিনাগুলি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই মূল্যবান ভেনামিকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের পাশাপাশি সমবায়,প্রাণী ও মৎস্য প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে বলে জানান। বৈশ্বিক চাহিদার সাথে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষসহ অন্যান্য লোনাপানির মৎস্যচাষ লাভজনক কিনা কিংবা স্হানীয় সংকট মোকাবেলায় নতুন উপযোগী সহায়ক পন্য কিংবা লাভজনক উৎপাদনশীল কি কি হতে পারে সেটা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

সামগ্রিকভাবে, ড. মিস্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি উদ্ভাবন, টেকসইতা এবং সহযোগিতার উপর ফোকাসসহ বাংলাদেশের কৃষি ও জলজ কৃষি খাতকে রূপান্তরের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের প্রতিনিধিত্ব করে।

বিজ্ঞানী ড. মিস্ত্রী বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ে গবেষণার কাজে তাঁর গবেষণা কেন্দ্রের স্হান পরিদর্শন করেছেন। তিনি তরুন উদ্দ্যোক্তা, শিক্ষার্থী, যুব সংগঠক, স্বেচ্ছাসেবকদের এ কাজে এগিয়ে নিতে সহযোগিতা চান। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু সফলভাবে আন্তজার্তিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে চান। গবেষণার কাজকে আরো সৃজনশীল, আধুনিক ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নিয়ে তরুনদের সম্পৃক্ত করতে চান, উদ্দ্যোগী হিসেবে গতিশীল করতে চান।তিনি আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে সেটা নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন,সফল হতে চান। গবেষণাকে এগিয়ে নিতে দেশবাসীর কাছে আশীর্বাদ চান এই প্রবীন উদ্দ্যোক্তা ও গবেষক।

   


পাঠকের মন্তব্য