বোরহানউদ্দিন উপজেলায় এবি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কর্মসূচি ও মূল্যায়ন

মিয়া মনসফ, কলামিস্ট ও সভাপতি, কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা।

মিয়া মনসফ, কলামিস্ট ও সভাপতি, কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা।

মিয়া মনসফ : প্রচন্ড মুষলধারের বৃষ্টি শুরু হলো। সকাল থেকে বোরহানউদ্দিন মিলনায়তনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে জড়ো হতে শুরু করেছে এবি ব্যাংকের ঋণ প্রত্যাশী কৃষকরা। আজ এখানে দুই সহস্রাধিক প্রান্তিক কৃষককে ঋণ দেয়ার কর্মসূচি উদ্বোধন হবে। কৃষকদের ঋণ দেয়া হবে স্বল্পসুদে। তাও স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে। 

বোরহানউদ্দিনের কৃষকরা এবি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কর্মসূচি শুনেছে অনেক আগে। কেউ শুনেছে আরেক কৃষক থেকে, কেউবা স্থানীয় ব্যাংক থেকে জেনেছে। পূর্বে ঋণ দেয়ার সংবাদ দেখেছেন টেলিভিশনে। কিন্তু বোরহানউদ্দিন উপজেলায় কবে ঋণ দেয়া হবে! বা আদৌ দেয়া হবে কিনা, এখানকার কৃষকরা জানেন না। তাই অত্র এলাকার অনেক কৃষক টিভি দেখেছে প্রতিনিয়ত এবি ব্যাংকের ঋণ বিতরণের খবর জানতে।

এই তথ্যগুলো জেনেছি বোরহানউদ্দিন অডিটরিয়ামে গত বৃহস্পতিবার এবি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপজেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ঋণ প্রত্যাশী কৃষকদের সাথে কথা বলে। বেশ কয়েকজন কৃষকের সাথে কথা বলে বোঝা গেলো তারা আধুনিক ও সুশিক্ষিত কৃষক। 

তাদের মনের অভিব্যক্তি জানার জন্য জানতে চাইলাম আপনি তো প্রকৃত কৃষক। আপনি ঋণের জন্য যেহেতু আবেদন করেছেন এবি ব্যাংকের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা আপনার আবেদনপত্র যাচাই বাছাই করে মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে তো ঋণ পাবার সংবাদ জানিয়ে দেবেন আপনাকে। এতো কষ্ট করে এখানে এসেছেন কেন? জবাবে বোরহানউদ্দিন উপজেলার চড্ডোস গ্রামের কৃষক মোঃ রুবেল জানালেন, আমি যদি ঋণ পাবার জন্য নির্বাচিত হই সেই ঋণ যথার্থ ব্যবহারে আজকের অনুষ্ঠানের অতিথিরা পরামর্শ দেবেন শুনেছি। সেই পরামর্শ আমি আমার কৃষি কাজে ব্যবহার করতেই এখানে আসা। একই বক্তব্য বোরহানউদ্দিন পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কৃষক দীন ইসলামের। নিজের দেড় একর জমিতে কৃষি কাজ করেন তিনি। ধান ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন করেন। এবার তিনি মাছ চাষ শুরু করবেন এবি ব্যাংকের ঋণ পেলে।  তিনি জানতে চান, ঋণ যথাসময়ে ফেরত দিলে আরো ঋণের জন্য আবেদন করা যাবে কিনা। আমি তাকে পরামর্শ দিয়ে বলেছি, অনষ্ঠানের শেষ অবধি অতিথিদের বক্তব্য শুনলে আপনার কাঙ্খিত পরামর্শ পেয়ে যাবেন। 

পাশ থেকে কৃষক কবিরুল, রুহুল আমিন ও নাজিমউদ্দিন খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিলেন বোরহানউদ্দিনের ঋণপ্রত্যাশী কয়েকজন কৃষকের সাথে আমার কথোপকথন। প্রত্যক্ষ করলাম এবি ব্যাংকের ঋণ প্রাপ্ত হলে প্রত্যেকেই তাদের ভাগ্যোন্নয়নে সুযোগ পাবে।

আজ বোরহানউদ্দিন উপজেলার প্রায় দুই সহস্রাধিক কৃষককে ঋণ বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধন হলো। অত্র এলাকার সাংসদ আলী আজম মুকুল প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এবি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। এই প্রথমবারের মতো তাকে দেখেছি। তাঁর কথা শুনেছি। তাঁর কথা শুনে বুঝলাম তিনি একজন সাংসদ হিসেবে গণমানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। মুষলধারের বৃষ্টির মধ্যেই তিনি যথাসময়ে অনুষ্ঠানে এসে পৌঁছেছেন। বক্তব্য দেবার সময় কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বোরহানউদ্দিন উপজেলার এই জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি। মিলনায়তন ঠাসা তাঁর উপজেলার তৃণমূল পর্যায়ের খেটে খাওয়া মানুষরা এখানে উপস্থিত। তাঁর সামনে যে কৃষকরা বসে আছেন ওরাই আজকের অনুষ্ঠানের মধ্যমনি। 

যাদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন আলী আজম মুকুল। চেয়ারে এই তৃণমুলের মানুষগুলো হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় দেখে একজন জনপ্রতিনিধি খুশিতেই আবেগাপ্লুত হওয়া স্বাভাবিক। তারপর তিনি এবি ব্যাংকের এই ঋণ বিতরণ আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এলাকার কৃষকদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, এই দেখুন সেই সকাল থেকে মুষলধারের বৃষ্টির মধ্যে এসেছেন আমার এলাকার মানুষগুলো, বৃষ্টির কারণে অনুষ্ঠান বিলম্ব সত্ত্বেও একজন কৃষকও অনুষ্ঠান ছেড়ে যাননি। এতো সুন্দর অনুষ্ঠান আয়োজন ইতিপূর্বে কখনো এখানে হয়নি। এজন্য তিনি আয়োজক এবি ব্যাংকের  প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান। 

আসলে এসব কৃতিত্ব এবি ব্যাংকের চৌকষ কর্মকর্তাদের। মিলনায়তনটি  জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়েছে অব্যবহারের কারণে। রাতদিন কাজ করে মিলনায়তনটি একটি জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের উপযোগী করা হয়েছে। 

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি তাঁর বক্তব্যে বলেন, আমার প্রিয় নেত্রীর নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। বিশে^র অনেক দেশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সেখানে আমাদের দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্নতা অর্জন করেছে। এসব কৃতিত্ব আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও আমাদের কৃষক ভাইদের। তিনি কৃষক ভাইদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা এবি ব্যাংকের ঋণ যথাযথভাবে কাজে লাগাবেন। এবং যথসাময়ে ফেরত দিলে আবা ঋণ নিতে পারবেন।

এবি ব্যংক এই ঋণ বিতরণ শুরু করে চলতি বছরের শুরুতেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা সফল বাস্তবায়ন করতে কৃষি উৎপাদনকে গুরুত্ব দিয়ে এবি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর তারিক আফজাল সহজ শর্তে প্রান্তিক কৃষকদের স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ উদ্ভাবন  করেন। এই কর্মসূচির মাধ্যমে ১৬ তম জেলা হিসেবে ভোলার বোরহানউদ্দিনে এই ঋণ বিতরণের আয়োজন করে এবি ব্যাংক।

সকাল থেকে কৃষকরা মিলনায়তনে অপেক্ষমান। বিশেষজ্ঞ অতিথিরা কৃষক ও  কৃষি নিয়ে কথা বলেছেন। কৃষি পণ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন কৃষকদের। ঋণপ্রত্যাশী কৃষক কিষাণী এইসব কথা শুনেছেন মনোযোগ সহকারে।

বরিশাল বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক স্বপন কুমার দাশ এবি ব্যাংকের এই ঋণ বিতরণ কর্মসূচির ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, এবি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কর্মসূচি দেশের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত আকর্ষনীয়। আধুনিক ব্যাংকিংয়ে লেনদেনের ফলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। তিনি আরো বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বাস্তবধর্মী বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার পূর্ণ করে উন্নত রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। 

এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার খায়রুল আলম চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভিশন বাস্তবায়নের জন্য এবি ব্যাংক এই ঋণ বিতরণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, এক সময় একজন কৃষক ৫ হাজার টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারতো না। কিন্তু আজ কৃষক ঋণ নিয়ে সেই ঋণ কৃষি কাজে ব্যবহার করে কৃষি পণ্য উৎপাদন করছেন এবং পণ্য বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা শোধ দিয়ে নিজের ভাগ্যোন্নয়ন করতে সক্ষম হচ্ছেন। 

তিনি আরো বলেন, পদ্মাসেতু দক্ষিণাঞ্চলে যে পরিবর্তনের সুবাতাস বয়ে দিয়েছে তা এক কথায় বিরল। আজ এখানকার কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য মাত্র কয়েক ঘন্টায় ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে। কৃষক ন্যায্য দাম পাচ্ছে। দেশের জনগন খাদ্য পাচ্ছে। এই সব কিছুর অবদান আমাদের ্আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তাঁর উৎসাহ ও প্রেরণায় এবি ব্যাংক এগিয়ে এসেছে দেশের খাদ্যোৎপাদন বাড়াতে। প্রান্তিক কৃষকদের স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে সহজশর্তে ঋণ বিতরণ কর্মসূচির ব্যবস্থা করেছে।

স্মার্টকাডের মাধ্যমে এই ঋণ বিতরণ কর্মসূচির প্রবক্তা এবি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনার পরিচালক তারিক আফজালের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে কৃষি ঋণ বিতরণের সুফল। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত দেশের ৪৩৯টি ইউনিয়নের ২৫ হাজার কৃষককে ২৫হাজার স্মার্ট কার্ডে ঋণ দেয়া হয়। সাড়ে বারো হাজার একর  জমিতে ২৪ হাজার মেট্রিকটন খাদ্যোৎপাদন করা হয়। 

তিনি আরো বলেন, দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন খাদ্যোৎপাদন বাড়াতে আহবান জানালেন তখন প্রান্তিক কৃষকদের সহযোগিতার কথা ভাবি। তাদের কিভাবে সহযোগিতা করে কৃষিপণ্য উৎপাদনে সাহায্য করা যায় সেই চিন্তা করি। অবশেষে স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ করে দেশের খাদ্যের চাহিদা মিটানোর সংগ্রামে আমাদের এবি ব্যাংক পরিবারকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি বলে নিজেকে কিছুটা ধন্য মনে করছি। 

১৬তম জেলায় এবি ব্যাংকের এই সফল ঋণ বিতরণ কর্মসূচি অত্যন্ত সফলভাবে সুসম্পন্ন হবার একমাত্র কারণ এবি ব্যাংক পরিবারের ম্যানেজম্যান্ট, পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে আন্তরিকতার মেলবন্ধন। আরো প্রত্যক্ষ করেছি ব্যাংকের সম্মানিত চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মধ্যে যে বোঝাপড়া তা একটি ঐতিহ্যবাহী বেসরকারী ব্যাংকের অগ্রযাত্রার উচ্চ শিখরে নিয়ে আসার জন্য যথেষ্ট। 

ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহোদয় ভোলার বোরহানউদ্দিনের ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্ম নেয়া সন্তান। তিনি ঋণ বিতরণ কর্মসূচি শেষে যেসকল কর্মকর্তা কর্মচারী দিনরাত কষ্ট করে ঋণ বিতরণ কর্মসূচিকে সফল করেছেন তাদের নিজ বাড়ীতে নিয়ে আপ্যায়ণের ব্যবস্থা করেছেন। এ ধরনের উদ্যোগ যেকোন বড় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীরা দায়িত্ব পালনে উৎসাহ ও প্রেরণা পাবেন এটাই স্বাভাবিক। চারদশকের একটি বেসরকারী ব্যাংক এভাবেই মানুষের সেবা ও দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় অবদান রেখে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে।  

বিশ্ব মন্দায় দেশের খাদ্য সংকট মোকাবেলায় দেশের প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে যে অবদান রেখে চলেছে, বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও দেশের মানুষ এবি ব্যাংকের অবদান কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণে রাখবে। 

লেখক : কলামিস্ট, সভাপতি, কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা।

 

 

   


পাঠকের মন্তব্য