উপনির্বাচন শেষে রঙ্গলালের হাতিরঝিল বনানী লেক পরিদর্শন

মিয়া মনসফ, কলামিস্ট ও সভাপতি, কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা।

মিয়া মনসফ, কলামিস্ট ও সভাপতি, কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা।

মিয়া মনসফ : গতকাল ছিল গুলশান বনানী আসনের উপনির্বাচন। সাধারণত যে কোন স্থানে নির্বাচন হলেই রঙ্গলাল নির্বাচন দর্শনে হাজির হয়ে যায় ঐ নির্বাচনী এলাকায়। গুলশান বনানী উপনির্বাচন পরিদর্শনেও যেতে ভুলে যায়নি রঙ্গলাল। 

খুব সকালে বেরিয়ে পড়লো গুলশান বনানীর উদ্দেশ্যে। মালিবাগ থেকে বাসের জন্য দাঁড়িয়েছিল দীর্ঘক্ষণ। বাসে কিছুতেই উঠতে পারলোনা রঙ্গলাল। একটু খর্বাকৃতির বলে যাত্রী ঠাসা বাসে উঠে রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয় বলেই এবার রঙ্গলাল হাঁটা শুরু করলো গুলশানের দিকে। ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে রঙ্গ। সকাল ৮টায় নির্বাচন শুরু হবে। নির্বাচনের শুরুটা দেখতেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পরলো সে। হাঁটতে হাঁটতে রঙ্গলাল ভাবছে ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারবে তো! 

রঙ্গলাল রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত হেঁটে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। এবার একটু জিরায় হাতিরঝিলের ব্রিজে। রেলিং ধরে একটু সময় দাঁড়িয়ে হাতিরঝিলের সৌন্দর্য্য দর্শন করে। বিস্তীর্ণ পানি দেখে খুব আনন্দবোধ করছে রঙ্গলাল। আবার গুলশানের দিকে হাঁটতে থাকে। ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা। আধা ঘন্টা পরেই শুরু হবে নির্বাচন। হাঁটতে হাঁটতে স্মার্ট ফোনটির ক্যামেরা চেক করে নেয়। উপনির্বাচনে ভোট দিতে আসা ভোটারদের ছবি তুলবে রঙ্গলাল। সেই ছবি পোস্ট দিবে নিজের আইডি থেকে। 

ভাবতে ভাবতে গুলশান এলাকায় ঢুকে পড়লো রঙ্গলাল। বড়লোকের আবাসিক এলাকা গুলশান বনানী। বড় রাস্তা ধরে হাঁটছে। বড় বড় সুউচ্চ দালানে বড় বড় কর্পোরেট অফিস। রাস্তায় গাড়ি চলাচল কম। বড়লোকরা তো ঘুম থেকে একটু দেরিতেই উঠবে! তাই স্বাভাবিক। ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খুঁজতে থাকে ভোট কেন্দ্র। অনেক হাঁটলো কিন্ত কোন ভোট কেন্দ্র চোখে পড়লোনা। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়া দু একজনের কাছে জানাতে চাইলেন এই এলাকার ভোট কেন্দ্র কোথায় ? কেউ বলতে পারলো না। রঙ্গলালের উদ্দেশ্যে, আমি এই এলাকার ভোটার না বলেই নিজ গন্তব্যে পা চালালেন পথচারী! 

খুব সমস্যায় পড়ে গেলো রঙ্গলাল। ঘড়িতে আটটা ছুঁই ছুঁই। এখনই নির্বাচন শুরু হয়ে যাবে। নির্বাচনের ভোটারদের লাইন ধরা প্রথম ছবিটি আর সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করা হলোনা। এবার দৌঁড়াতে থাকে। রঙ্গলালের ধারণা কোথাও না কোথাও  ভোট কেন্দ্র পাওয়া যাবে!

হঠাৎ রঙ্গলালের এমন দৌড়ানো দেখে একজন পথচারী তাকে ডাক দিয়ে থামালেন। জানতে চাইলেন, ভাই আপনি দৌড়াচ্ছেন কেন ?

ভাই, সাধে কি দৌড়াইতাছি ! আপনি আমারে থামাইয়া মসিবতে ফেলাইলেন। ভোট কেন্দ্র খুইজ্যা তাড়াতাড়ি ছবি পাঠাইবার না পারলে চাকুরি তো নট !

ভদ্রলোক অবাক হলেন, ভোট কেন্দ্র না পেলে চাকুরী যাবে কেন? জানতে চাইলো রঙ্গলালের কাছে।  এবার রঙ্গলাল বুঝিয়ে বললেন গুলশানের মনিরুল ইসলাম নামে গুলশান এলাকায় বসবাসরত ভদ্রলোককে। যিনি একজন এই নির্বাচনী এলাকার ভোটার। তিনিও বেরিয়েছেন ভোট কেন্দ্রের খোঁজে। রঙ্গলাল তাঁর কথা শুনো আরো অবাক! 

মনিরুল ইসলামের উদ্দেশ্যে রঙ্গলাল বললেন, আপনে এই এলাকার বাসিন্দা অইয়া ভোট কেন্দ্র খুইজ্যা পাইতাছেন না! তাইলে আমি পামু কেমনে ! রঙ্গলাল মনিরুল ইসলামকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, ইন্টারনেট ঘাইট্যা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেইক্যা ভোট কেন্দ্র খুইজ্যা লন !

এতক্ষন তাদের দু’জনের কথোপকথন আরেকজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন। তিনিও অত্র এলাকার ভোটার।
তিনি এবার বলে উঠলেন,  আরে ভাই গতকাল থেইক্যা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট ঘাইট্টা মরতাছি  কোন কেন্দ্রই খুইজ্যা পাইনাইক্কা।  

তিনজনে বিড় বিড় করে কথা বলতে বলতে যার যার মতো করে কেন্দ্র খুঁজতে লাগলো। তিনজনের কে আগে কেন্দ্র খুঁজে পেলো তা আর জানা গেলোনা। 

তবে রঙ্গলাল খুঁজে পেলো কেন্দ্র। মানারাত স্কুলের গেইট পেরিয়ে সবুজ ঘাসের মাঠ পেরিয়ে রঙ্গলাল ভোট কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যেতে থামিয়ে দিলেন নিরাপত্তাকর্মীরা। নিজের পরিচয় দিতেই বাঁধা ডিঙ্গিয়ে ভোট কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে গেলো রঙ্গলাল। 

রঙ্গলাল ভাবে ! সত্যি এটি ভোট কেন্দ্র! ঘড়িতে ক্যালেন্ডারের তারিখ দেখে নেয়, আজ সতের জুলাই ঠিক আছে তো! সবই ঠিক আছে। এটি গুলশান এলাকার একটি ভোট কেন্দ্র। ভোট কেন্দ্র আছে ভোটার নাই! ভেতরে গিয়ে দেখে। দু একজন ভোটারও আছে কিন্তু কোন লাইন নাই। অলস বসে আছে নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত। রঙ্গলালকে ভোটার মনে করে একজন তাকে ডাক দিয়ে বললেন, ভাই ভোট দিতে আসছেন! আসেন! আসেন ভাই আসেন ভোট দিয়ে যান। 

কিন্তু রঙ্গলাল ভোটার না হওয়াতে তাদের ডাকে সাড়া দিলেন না। কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করে অন্য কেন্দ্রের খোঁজে বেড়িয়ে গেলেন। এভাবে ঘুরে ঘুরে প্রায় বেশ কয়টি ভোট কেন্দ্র ঘুরেছেন। কোন কেন্দ্রে ভোটারের লাইন চোখে পড়েনি। নির্বাচনে ভোট দেওয়ার প্রথম ভোটারের ভোট দেবার দৃশ্যটি আর আপলোড করা হলোনা তার টাইম লাইনে। 

একটি ভোট কেন্দ্রে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছিলেন একজন ক্রিকেট কর্মকর্তা। এই দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে গেলো রঙ্গলাল। তিনি বললেন গুলশান এলাকায় মশার উপদ্রব বেশি। যিনি নির্বাচিত হবেন তাকে প্রথমে এই বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতে হবে। 

এই কথা শুনে একটু অবাক হলেন রঙ্গলাল! এখানে তো বড় লোকের আবাসস্থান । এখানাকার রাস্তাঘাট হবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। মশা বেশি হবার কথা নয়। এমনটিই ভাবে রঙ্গলাল। ভোট কেন্দ্রটি লেকের ধারে অবস্থিত। সেখান থেকে রঙ্গলাল এবার বের হলো লেক দর্শনে। 

একবার ধানমন্ডির লেক দর্শনে গিয়েছিল রঙ্গলাল। লেকের পাড়ে বসে লেকের সৌন্দর্য দেখেছে। লেকের পাড়ে বড় বড় গাছের সারি দেখেছে। স্বচ্ছ পানিতে বড়শিতে মাছ ধরার দৃশ্য দেখেছে। স্বচ্ছ লেকের পানি ছুঁয়ে দেখে রঙ্গলাল খুব শান্তি অনুভব করেছে।

ভোটের দৃশ্য অবলোকন করতে করতে ভোট শেষে এবার গুলশান লেক দর্শনে হাটতে লাগলো লেকের পাড় ধরে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় নাকে হাত দিয়ে চেপে ধরতে বাধ্য হলো রঙ্গলাল। কী দুর্গন্ধ! লেকের পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। ধানমন্ডি লেকের সাথে গুলশান বনানীর লেকের পার্থক্য নির্ণয় করার চেষ্টা করলো রঙ্গ। দুই লেকের মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক। ধানমন্ডি লেকের পানি স্বচ্ছ। স্বচ্ছ পানিতে মাছ চাষ হয়। আর হাতিরঝিল গুলশান বনানী লেকে মাছ তো দূরের কথা,  কোন জলজপ্রাণী নেই। বিষাক্ত পানি। আর এই লেক মশা উৎপাদনের যেন এক হ্যাচারী। এই লেক থেকেই জন্ম নেয়া মশা অভিজাত এলাকা গুলশান বনানীর মানুষগুলোকে হুল ফুটিয়ে আরামের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে।

কেন হাতিরঝিল গুলশান বনানী লেকের এই অবস্থা রঙ্গলাল এই রহস্য উদঘাটন করতে লেকের পাড় বেয়ে হাঁটতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে আবিষ্কার করলো লেকের কেন এই দৈন্যদশা। 

দুই হাজার দুইশ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি সংস্থা বেগুনবাড়ি খাল ও হাতিরঝিলের উন্নয়ন করে এই শহরের একটি দৃষ্টিনন্দন জায়গায় পরিণত করেছে। রাজধানীতে বসবাসরত মানুষের একটি বিনোদন কেন্দ্র। এই লেক গুলশান বননীর সাথে সংযুক্ত। এই লেকে ১১ টি পয়েন্ট দিয়ে ঢাকার বসবাসরত এক কোটি মানুষের পয়োবর্জ্য ঢুকে পড়ছে। আশেপাশের বাসা বাড়ি থেকে ময়লা আবর্জনা ফেলছে। লেকে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা খাবারের উচ্ছিষ্ট, পানির খালি বোতল, চিপসের খালি প্যাকেট লেকে ফেলছে মানুষজন। ঢাকার দুর্বল পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার কারণে এই লেক এখন মশা উৎপাদনের হ্যাচারীতে পরিণত হয়েছে। এই লেক দেখভালের জন্য একটি অথরিটি আছে। কিন্তু কোন রক্ষণাবেক্ষণ নেই। ফলে লেকের অবস্থা যা হবার তাই হচ্ছে। 

তাহলে এই গুলশান বনানী এলাকায় মশার উপদ্রব কমবে কিভাবে! আজকের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যিনি নির্বাচিত হবেন তিনি এলাকাবাসীর প্রথম দাবী হিসেবে লেকের সঠিক পরিচর্যা করে স্বচ্ছ পানির লেকে পরিণত করলে গুলশান বনানী এলাকার মানুষ মশার উপদ্রব থেকে কিছুটা মুক্তি পাবে। এমনটি মনে করছে রঙ্গলাল।

সন্ধ্যা যখন ঘনিয়ে এলো তখন রঙ্গলাল বাড়িমুখি হলো। এমন সময় বাড়ি থেকে গিন্নি ফোন করে রঙ্গলালকে জানালো হিরু আলমের উপর হামলা হয়েছে। একথা শুনে রঙ্গলালের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। ভোটার কম হলেও একটি সুন্দর নির্বাচন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। একটি সুন্দও নির্বাচন আয়োজনের সমাপ্তির পথে কে কালিমা লেপন করলো ! সরকারী দল কি চাইবে শেষ মুহূর্তে বদনামের ভাগীদার হতে! এমনটাই নির্বাচন নিয়ে রঙ্গলালের মূল্যায়ন। নাকি ডাল মে কুচ্ কালা হে ! 

লেখক : কলামিস্ট ও সভাপতি, কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা।

   


পাঠকের মন্তব্য