ইতিহাসের ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র (পিসি) রায়

মহাপুরুষ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র (পিসি) রায়

মহাপুরুষ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র (পিসি) রায়

ফাদার অব নাইট্রাইট খ্যাত বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী

পূর্ণ চন্দ্র মন্ডল : ইতিহাসের ক্ষণজন্মা মহাপুরুষদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রসায়নবিদ, বিজ্ঞানশিক্ষক, দার্শনিক ও কবি আচার্য স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। তিনি ছিলেন অনেক গুণে গুণান্বিত। খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার কপোতাক্ষের তীরে অজপাড়া রাডুলি গ্রামে ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট তিনি জন্মগ্রহণ করেন। 

তিনি মা ভূবনমোহিনী দেবী এবং পিতার হরিশচন্দ্র রায়ের পুত্র। হরিশচন্দ্র রায় স্থানীয় জমিদার ছিলেন। ১৭ বিঘা জমির ওপর তাদের বিশাল বাড়ি। দোতলা বাড়িটির দুটো অংশ। একটি সদর মহল। আরেকটি অন্দর মহল। সদর মহলটি চার অংশে বিভক্ত। এর উত্তরাংশ পূজামণ্ডপ। আরবীয় ও ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এ ভবনটির পুবদিকে বিশাল পুকুর। আবার অন্দর মহলের দক্ষিণ পাশে আরেকটি পুকুর। 

বাড়িটির চারধার ঘিরে ইটের সীমানা প্রাচীর। বনেদি পরিবারের সন্তান প্রফুল্লচন্দ্র ছেলেবেলা থেকেই সব বিষয়ে অত্যন্ত তুখোড় ছিলেন। তার পড়াশোনা শুরু হয় নিজের গ্রামের বাবার প্রতিষ্ঠিত এম ই স্কুলে। জমিদার বংশের সন্তান হলেও অত্যান্ত সাদাসিধে জীবনের অধিকারী ছিলেন তিনি। ছোটবেলায় তার অন্যতম শখ ছিল স্কুল পালিয়ে পাতাঘেরা গাছের মগ ডালে বসে থাকা। ১৮৭২ সালে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান কলকাতার হেয়ার স্কুলে।  কিন্তু হঠাৎ করেই শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে । রক্ত আমাশয়ের কবলে পড়ে দুই বছর ভোগেন তিনি। পড়ালেখায় ব্যাপক বিঘ্নের সৃষ্টি হয়। বাধ্য হয়ে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে যান। তবে এই রোগ অন্য আরেক দিক দিয়ে তার জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে। এই দুই বছর প্রতিদিন তার ব্যক্তিগত ডায়েরি লিখেছেন। 

"স্কুলের শুকনো বইখাতা থেকে মুক্ত মুক্তি পেয়ে আমি সুযোগ পেয়েছিলাম নিজের পছন্দনুযায়ী বই পড়ার.." 

এই দুই বছর তিনি তার বাবার বইয়ের বিশাল সংগ্রহশালায় ডুবে ছিলেন। বইপাঠ তার জ্ঞানমানসের বিকাশসাধনে প্রভূত সহযোগিতা করে। অর্জন করেন নানা বিষয়ে অগাধ জ্ঞান ভান্ডার।

১৮৭৪ সালে প্রফুল্লচন্দ্র কলকাতায় ফিরে যেয়ে অ্যালবার্ট স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্কুল ফাইনার তথা প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন। ১৮৮১ সালে সেখান থেকে কলেজ ফাইনাল তথা এফএ পরীক্ষায় (ইন্টারমিডিয়েট বা এইচএসসি) দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। 

প্রেসিডেন্সী থেকে গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিএসসি পাশ করেন। পরবর্তীকালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়েই ডিএসসি ডিগ্রি লাভের জন্য গবেষণা শুরু করেন।

তার সেই গবেষণার বিষয় ছিল "কনজুগেটেড সালফেট অফ কপার ম্যাগনেসিয়াম গ্রুপ"।
 
দুই বছরের কঠোর সাধনায় তিনি এই গবেষণা সমাপ্ত করেন এবং পিএইচডি ও ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। এমনকি তার এই গবেষণাপত্রটি শ্রেষ্ঠ মনোনীত হওয়ায় তাকে হোপ প্রাইজে ভূষিত করা হয়। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই ১৮৮৫ সালে সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে এবং ভারত বিষয়ক বিভিন্ন নিবন্ধ লিখে ভারতবর্ষ এবং ইংল্যান্ডে সাড়া ফেলে দেন। 

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ১৮৮৮ সালে প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফেরার পর শুরু হয় রসায়নের অধ্যাপণা গবেষণা ও বিভিন্ন সামাজিক কাজ।পরের বছর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগ দেন। শুরু হয় তাঁর শিক্ষক ও গবেষকজীবন। ঘি সরষের তেল ও বিভিন্ন ভেষজ উপাদান নিয়েই তিনি প্রথম গবেষণা শুরু করেন। 

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১৮৮৯ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত ২৭ বছর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত কলিকাতা

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ১৯৩৭ সাল থেকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমেরিটাস প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এত দীর্ঘ বর্ণাঢ্য শিক্ষকতার জীবন খুব কম মানুষের ভাগ্যে হয়েছে। তার বাচনভঙ্গী ছিল অসাধারণ যার দ্বারা তিনি ছাত্রদের মন জয় করে নিতেন খুব সহজেই। তিনি সকল ক্ষেত্রেই ছিলেন উদারপন্থী। 

বাংলা ভাষা তার অস্তিত্বের সাথে মিশে ছিল। তিনি বুঝেছিলেন, বাংলায় বক্তৃতা ছাত্রদের অনুধাবনের পক্ষে সহায়ক। তাই ক্লাসে বাংলায় বক্তৃতা দিতেন এবং পড়ার সময় বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের জীবনকাহিনী এবং তাদের সফলতার কথা তুলে ধরতেন। নির্লোভ, পরোপকারী, শিক্ষাবিস্তারে নিবেদিতপ্রাণ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১৮৯২ সালে মাত্র ৮ শ টাকা মূলধন নিয়ে বেঙ্গল ক্যামিক্যাল প্রতিষ্ঠা করেন। কোম্পানিটির নাম কারণ করা হয় দি বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিটিক্যাল। পরবর্তীকালে ১৯০১ সালে তা কলকাতার মানিকতলায় ৪৫ একর জমিতে স্থানান্তরিত করা হয়। তখন এর নতুন নাম রাখা হয় বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড। 

১৮৯৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তাঁর প্রথম গবেষণা পত্রের নাম ছিল ‘অন দি কেমিক্যাল একজামিনেশন অফ সার্টেন ইন্ডিয়ান ফুড স্টাফস, পার্ট ওয়ান, ফ্যাটস অ্যাণ্ড অয়েলস।’ ১৮৯৫ সালে তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট (HgNO2) আবিষ্কার করেন যা বিশ্বব্যাপী আলোড়নের সৃষ্টি করে। এটি তার অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। তিনি তার সমগ্র জীবনে মোট ১২টি যৌগিক লবণ এবং ৫টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন। 

১৯০৩ সালে চারটি গ্রামের নাম মিলে বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায় দক্ষিণ বাংলায় প্রথম আর.কে.বি.কে হরিশচন্দ্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেন। একইস্থানে স্যার পিসি রায়ের পিতা উপমহাদেশে নারী শিক্ষা উন্নয়নকল্পে ভূবনমোহিনীর নামে ১৮৫০ সালে রাড়ুলী গ্রামে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে যখন বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন গোপনে অস্ত্র ক্রয়ের জন্য তিনি বিপ্লবীদের সাহায্য করেন। 

১৯০৯ সালে নিজ জন্মভূমিতে কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।  শিক্ষকতার জন্য তিনি সাধারণ্যে ‘আচার্য’ হিসেবে আখ্যায়িত। ১৯১১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে তৃতীয়বারের মতো তিনি ইংল্যান্ড যান এবং সেখান থেকেই সিআইই লাভ করেন। ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়। ১৯১৬ সালে কলকাতায় তিনিই প্রথমবারের মত মহাত্মা গান্ধীর জনসভা আয়োজন করেছিলেন। বাগেরহাট জেলায় ১৯১৮ সালে তিনি পিসি কলেজ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যা আজ বাংলাদেশের শিক্ষা বিস্তারে বিশাল ভূমিকা রাখছে। ১৯১৯ সালে তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে নাইট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতবর্ষের মহিশুর ও বেনারশ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়া ১৯৩৬ সালে ঢাকা
 
বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরবর্তীকালে মহীশুর ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি ডক্টরেট পান। মৃত্যুর আগে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি ও নাইট উপাধি অর্জন করেন। অনেক অজানা ইতিহাস রয়েছে, জীবনের শেষ ২০ বছর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট কামরা কামরায় কাটান। মাথার উপর পাখাকেও তিনি বিলাস দ্রব্য মনে করে ব্যবহার অস্বীকৃতি জানাতেন। তখনকার দিনে একটি নিয়ম ছিল শিক্ষক যখন ক্লাস নিবেন তার আগে একজন কর্মচারী এসে ব্ল্যাকবোর্ড টেবিল মুছে দিবে। এক শীতের দিনে দেখা গেল এক কর্মচারী কোট পরে ব্ল্যাকবোর্ড মুছতে এল। কিছুক্ষণ পর প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ও একই রকম একটি কোট পরে ক্লাসে প্রবেশ করলেন পরে জানা যায় , যে তিনি একই কাপড় থেকে দু'টি কোট বানিয়ে ছিলেন, একটি তার জন্য আরেকটি ওই কর্মচারীর জন্য। ১৯৪৪ সালে ১৬ জুন ৮২ বছর বয়সে কোলকাতার বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে জীবনাবসান ঘটে চিরকুমার বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের। 

এই বিজ্ঞানী তার জীবনের অর্জিত সমস্ত সম্পত্তি মানব কল্যাণে দান করে গেছেন।
 
শুধু তাই নয় বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে বিশ্বের বুকে উঁচু করে আত্মপরিচয়ে পরিচিত করতে যে ক'জন মহাপুরুষ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের অন্যতম স্যার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। এই কৃর্তিমান মহাপুরুষের জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেন করি।

লেখক- পূর্ণ চন্দ্র মন্ডল, লেখক ও সাংবাদিক।

 

 

   


পাঠকের মন্তব্য