এবি ব্যাংকের নারী উদ্যোক্তা ঋণ একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ

মিয়া মনসফ, সভাপতি, কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা
মিয়া মনসফ : যে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যখন কোন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে এবং সেই পরিকল্পনার সাথে দেশ ও মানুষের স্বার্থের বিষয় জড়িত থাকে, তখন সেই পরিকল্পনা বা উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়ন হয়। এবছরের শুরুতে বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারী ব্যাংক এবি ব্যাংক স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে সহজশর্তে প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে ঋণ বিতরণ শুরু করে। উদ্দেশ্য চলমান বৈশি^ক খাদ্য সংকট মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়ন করা।
প্রধানমন্ত্রী তখন দেশের জনগনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে। জনগনকে উদ্বুদ্ধ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলন, আমাদের দেশের উর্বর মাটিকে যদি যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি তাহলে আমরা খাদ্য সংকট মোকাবেলায় সক্ষম হবো। এজন্য সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
এবি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক অত্যন্ত বাস্তববাদী চিন্তাশীল মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে আমলে নিয়ে কৃষকদের সহযোগিতায় পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তিনি। কিভাবে প্রান্তিক কৃষকদের সহযোগিতা করে খাদ্যোৎপাদন বাড়ানো যায়। তিনি মনে করেছেন, খাদ্যোৎপাদনে কৃষকরাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য তিনি প্রান্তিক কৃষকদের আর্থিক সহযোগিতা দানের উদ্যোগ নেন। শুরু করেন মাঠ পর্যায়ে গবেষনা। এবি ব্যাংকের চৌকষ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রকৃত প্রান্তিক কৃষকদের তালিকা তৈরি করেন। এবং স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ২৫ হাজার কৃষককে ঋণ প্রদান করেছে এবি ব্যাংক। যার ফল এখন ভোগ করছে ঋণপ্রাপ্ত কৃষক ও এদেশের জনগন।
এই সফল কর্মসূচির পর নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণেও এবি ব্যাংক পিছিয়ে নেই। ব্যাংকের থিংকম্যান তারিক আফজাল দেশের নারী উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত। যে কথা সেই কাজ। শোকের মাস আগস্টেই এই কর্মসূচি উদ্বোধনের উদ্যোগ নেন। এই আয়োজন ছিল বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে শোকের মাসকে উপলক্ষ্যে করে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তুও ছিল অত্যন্ত অর্থবহ। ‘নারী উদ্যোক্তা ঋণ ও স্মরণে বঙ্গবন্ধু’। এই নামকরণ ও শোকের মাস আগস্টে এদেশের অবহেলিত নারী সমাজকে আর্থিক সহযোগিতা করে স্বাবলম্বী করার এবি ব্যাংকের প্রয়াস জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নারীদের উন্নয়ন কর্মকান্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
বঙ্গবন্ধু এদেশের উন্নয়নে নারীদের গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন স্বাধীনতা অর্জনের পরপর। জাতীয় সংসদে সর্ব প্রথম নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করেন। এবং তাঁর নেতৃত্বে নারী পূনর্বাসন বোর্ডও গঠন করা হয়। এই বোর্ডের কার্য পরিধি বৃদ্ধির ফলে পরবর্তী সংসদে একটি এ্যাক্টের মাধ্যমে বোর্ডকে নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশনে রূপান্তরিত করেন। এই সব কিছুর মূলে হচ্ছে দেশের উন্নয়নে নারীকেও সম্পৃক্ত করা।
বর্তমানে ষোল কোটি মানুষের বত্রিশ কোটি হাতের মধ্যে ১৬ কোটি হাতই নারী। নারীর ষোল কোটি হাতকে অব্যবহৃত রাখলে দেশের উন্নয়ন কিভাবে সম্ভব!
এবি ব্যাংক দেশের প্রান্তিক কৃষককে ঋণ প্রদানের পর এবার নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানে এগিয়ে এসেছেন দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে। দেশের চলমান অগ্রগতির ধারার অব্যাহত রাখতে নারী উদ্যোক্তাদের স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে ঋণ প্রদানের কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
২৩ আগস্ট আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এই কর্মসূচির ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, নারীদের পুরোপুরি উন্নয়ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করা গেলে উন্নত বাংলাদেশ গঠন খুব একটা বেশি সময় লাগবেনা। তিনি এবি ব্যাংকের পাশাপাশি অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে নারী উন্নয়নে এগিয়ে আসার আহবান জানান।
উদ্বোধনের পরের সপ্তাহেই এবি ব্যাংক ঋণ বিতরণের উদ্যোগ নেন হযরত শাহজালাল ও শাহ পরাণের পূণ্যভূমি সিলেট থেকে।
রোজভিউ হোটেলের ক্রীস্টাল ওয়ান হলরুমে প্রায় অর্ধশতাধিক নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে শুরু হয় কর্মশালা। এসময় সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা থেকে আগত নারী উদ্যোক্তারা বক্তব্য রাখেন। কিভাবে নারী উদ্যোক্তা হলেন! কিভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন!
গীতা দেব রায় একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। তিনি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থেকে এসেছেন। তার নারী উদ্যোক্তা হবার ইতিবৃত্ত তুলে ধরেছেন তার বক্তব্যে। তিনি বলেন, বাসায় বসে না থেকে কিছু করার চেষ্টা করি। তিনি শাড়ীতে বিভিন্ন নকশা তৈরির কাজ করেন। এভাবে করতে করতে বাজারে একটি দোকান নিয়ে বসেন। আস্তে আস্তে বেচা বিক্রি বাড়তে থাকে। তার হাতের তৈরি শাড়ী ও বিভিন্ন নকশার কাজ বিভিন্ন বিক্রিতার কাছে সরবরাহ করেন। তিনি বলেন, আমার এই কাজে স্বামীও সহযোগিতা করেন। কিন্তু মূলধনের জন্য ব্যবসার পরিধি বাড়াতে পারিনি।
এবি ব্যাংকের কর্মকর্তারা যখন আমাকে ঋণ দেবার কথা জানালেন তখন বিশ্বাসই করতে পারিনি ঋণ পাব। খুব সহজে এবি ব্যাংকের ঋণ পেয়েছি। এখন আমার ব্যবসার উন্নতি করার সুযোগ পাবো।
মালন দেবী, একজন মনিপুরী তাতী ও নারী উদ্যোক্তা। তিনি তাঁর জীবনের করুণ কাহিনী বর্ণনা করেছেন অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায়। আবেগপ্রবণ হয়ে তার উপস্থাপিত বক্তব্য শুনে অন্যান্য নারী উদ্যোক্তারা করতালিতে সিক্ত করেছেন মালন দেবীকে। তিনি কাজ শুরুর প্রাক্কালে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরতেই আবেগে দু চোখ বেয়ে চোখের জল পড়েছে, আবার পরক্ষণে তার সাফল্যের কথা তুলে ধরে আনন্দাশ্রু ফেলেছেন। জীবন কত কঠিন, কত বৈচিত্রময়। একজন নারী নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বা পরিবারের দায়িত্ব নিতে কত গঞ্জনা ব্যঞ্জনা সহ্য করতে হয়! তার বক্তব্যে স্পস্ট হয়ে উঠে এসেছে।
শামসুন নাহার সুমা উই এর সদস্য, কত ব্যাংকে ঋণ পেতে দৌড়াদৌড়ি করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। ঋণ পাননি। ঋণ পাবার চেষ্টা করতে গিয়ে কতরকম বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয়েছে তা উল্লেখ করতে গিয়ে তার গলা ধরে আসে। বক্তব্য সংক্তিপ্ত করে নিজেকে সামলে নেন। এবি ব্যাংকের ঋণের পাবার প্রত্যাশায় তিনি এসেছেন। এবি ব্যাংকের ঋণ পেয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, এতো সহজে ঋণ পাবো ভাবতে পারিনি। এবার তিনি নিজেকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবার স্বপ্নের কথা তুলে ধরেন। এইভাবে মন্টি ঘোষ,গীতা রানী, তপসী রানীরা তাদের উদ্যোক্তা হবার গল্প তুলে ধরেন এবি ব্যাংক আয়োজিত স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ কর্মসূচির প্রথম অনুষ্ঠানে।
নারী উদ্যোক্তাদের দ্বিতীয় কর্মসূচি ছিল বন্দর নগরীর চট্টগ্রামের ক্লাবে। প্রায় দু শতাধিক নারী উদ্যোক্তা এবি ব্যাংকের ঋণ প্রত্যাশী এখানে উপস্থিত হয়েছেন গত ৩ সেপ্টেম্বর। নারী উদ্যোক্তা বক্তারা তাদের নারী উদ্যোক্তা হবার গল্প তুলে ধরেছেন। নারী উদ্যোক্তাদের বক্তব্য শুনে অন্যান্য উদ্যোক্তারাও উৎসাহী হয়েছেন নিজেদের গড়ে তোলার। এবি ব্যাংকের স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ কর্মসূচি নারী উদ্যোক্তাদের স্বাবলম্বী হবার সুযোগ করে দেবে। অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নারী উদ্যোক্তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে, সেই প্রত্যাশা সকলের।
লেখক : কলামিস্ট ও সভাপতি, কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা।
পাঠকের মন্তব্য