নামাজ ছিল কুরআনের আইন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া

প্রধান ইবাদত হচ্ছে সালাত বা নামাজ

প্রধান ইবাদত হচ্ছে সালাত বা নামাজ

কুরআনে আল্লাহ বারবার সালাত প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। মুসলমান হিসেবে আমাদের প্রধান ইবাদত হচ্ছে সালাত বা নামাজ। কিন্তু মুসলমানদের জন্য আল্লাহর সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ এবং অনুমোদিত জীবনবিধান পবিত্র কুরআনে নামাজের পরিচিত কাঠামোর সুস্পষ্ট বর্ণনা নেই। প্রতিদিন কত ওয়াক্ত নামাজ, কোন কোন সময়ে পড়তে হবে, কোন নামাজ কত রাকাত, প্রতি রাকাতে কী কী পড়তে হবে, ঈদ, জানাজা, তারাবিহ'র নামাজের পদ্ধতি সম্পর্কে কুরআনের বর্ণনা থেকে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না। কিন্তু কুরআনের দশ-পনেরো আয়াতে আমাদের পরিচিত নামাজের প্রতিটা জিজ্ঞাসার জবাব দেয়া সম্ভব।

কুরআনে আল্লাহ সালাত কায়েম করতে বলেছেন কিন্তু হাদিস ছাড়া সালাত কায়েম করবেন কীভাবে? কুরআনে তো পরিচিত সালাতের নিয়ম নেই। খুব সহজ উত্তর হচ্ছে, কুরআনে সালাতের নিয়ম না থাকলে সালাত বলতে আমাদের প্রতিদিনের নামাজ বুঝানো হয়নি। দোয়া বা প্রার্থনা অর্থে সালাত শব্দটি ব্যবহৃত হলেও কুরআনে সালাত প্রতিষ্ঠা বলতে প্রধানত ‘কুরআনের নিরবচ্ছিন্ন অনুসরণকে বুঝানো হয়েছে।

নামাজের নিয়ম জানার জন্যই প্রধানত আমাদের হাদিসের প্রয়োজন পড়ে। কারণ কুরআনে নামাজের সুনির্দিষ্ট কাঠামো নেই কিন্তু হাদিস থেকে নামাজের সর্বসম্মত কাঠামো বের করা কোনো সাধারণ শায়খুল হাদিসের পক্ষেও অসম্ভব। হাজার হাজার হাদিস থেকে ছোট ছোট তথ্য জোড়া দিয়ে ইজমা-কিয়াসের ভিত্তিতে নামাজের পরিচিত কাঠামো তৈরি করেছেন ইমাম আবু হানিফা, শাফেয়ী, মালেক ও হাম্বলের মতো সর্বকালের স্কলাররা। আহলে হাদিসের লোকরা নাসিরুদ্দীন আলবানীর মাজহাব বা তার বই অনুযায়ী নামাজ পড়ে।

আমরা যে নামাজ পড়ি তার আগা-মাথা কিছুই আমরা বুঝি না। নামাজ পড়া না পড়াকেই আমরা পাপ-পুণ্য মনে করি। হাদিস, ফিকাহ ঘেঁটে নামাজের হাজার হাজার মাসআলা ম্যানুফ্যাকচার করছি যেসবের সাথে নামাজের উদ্দেশ্য-বিধেয় কোনো সম্পর্কই নেই। সারা জীবন নামাজ পড়া বেশির ভাগ মানুষকে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে না-নামাজে তারা কী পড়ে। বিদেশি ভাষার সুমধুর সংগীতের মতো কোনো অর্থহীন মন্ত্র মানুষের ভাবনায় কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। রাসূল (সা.)-এর কুরআনের পাঠচক্রে কেউ বিদেশি ভাষার মন্ত্র পড়ত বা শুনত না। মাতৃভাষায় শুনত জীবনের পথ-পাথেয়।

হাদিস ছাড়া নামাজ পড়বেন কীভাবে? এসব প্রশ্ন যারা করেন তারা বেশির ভাগ নামাজ অধ্যায়ের হাদিস আদ্যোপান্ত পড়েননি। এই বেশির ভাগ মানুষ বলতে বুঝাচ্ছি বেশির ভাগ শায়খুল হাদিস। নামাজের যেসব হাদিস আমাদের শায়খরা জানেন তার জন্য মাদ্রাসায় পড়তে হয় না। যেসব বিতর্কিত মাসআলা নিয়ে বিশ্বযুদ্ধ চলছে সেসব মাসআলার পক্ষে-বিপক্ষের দলিল খুঁজতে এন্টার্কটিকা মহাদেশ পর্যন্ত যাবে। কিন্তু ঝগড়ায় না লাগলে নাকের ডগার হাদিসও জানে না। নামাজের ছোট ছোট মাসআলা নয়, দিনে কয় ওয়াক্ত নামাজ, কোন কোন সময়ে কত রাকাত করে পড়তে হবে, প্রতি রাকাতে কয় রুকু, কয় সিজদা-এসব গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসার জবাব হাদিস ছাড়া দেয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ইসলাম ধর্মের প্রধান ইবাদত যা সকল মুসলমানের ওপর সর্বাবস্থায় ফরজ তার কোনো ধারাবাহিক নিয়ম একটি হাদিসে নেই। 

নামাজ ছিল কুরআনের আইন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া।

মসজিদে নববীতে প্রতিদিন পাঁচ বার সমাজের সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতিতে কুরআন পড়া হতো। আর রাসূল (সা.)-এর সাথে যারা নামাজ বা কুরআনের পাঠচক্রে অংশ নিত তাদের জন্য কুরআন তো বাংলা। অর্থাৎ কুরআন তাঁদের মাতৃভাষা; কুরআন বুঝার জন্য তাদের তো আলাদা করে ভাষা-ব্যাকরণ কিছুই শেখার প্রয়োজন ছিল না। ঐতিহাসিক সূত্র মতে আরবের বিভিন্ন গোত্র তাদের আঞ্চলিক ভাষায় কুরআন পাঠ করতো এবং আঞ্চলিক ভাষায়ই কুরআন লিখত। হজরত ওসমান (রা.)-এর সময়ে কুরআনের আঞ্চলিক কপিগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়। রাসূল (সা.)-এর সময়ে মানুষ তাদের আঞ্চলিক ভাষায় কুরআন পড়ত। অর্থাৎ কুরআন পাঠ ছিল পাঠকের পরিচিত ও বোধগম্য ভাষায়। এখনো সারা পৃথিবীতে কুরআনের সাতটি স্বীকৃত উচ্চারণ (কেরাত) আছে।

সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কুরআনের পাঠচক্রে অংশ নিতে পারত—এটাই ছিল সে সময়ের অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের সাথে কুরআনের অন্যতম প্রধান পার্থক্য। মধ্যযুগের ইউরোপে (পঞ্চম খ্রিষ্টাব্দ থেকে পঞ্চদশ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত) সামাজিক মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বণ্টন তিনটি ভাগে (estates of the realm) বিভক্ত ছিল-যার প্রথমটি (First Estate) ছিল Clergy, ধর্মযাজক শ্রেণি (the body of all people ordained for religious duties, especially in the Christian Church.), এই ধর্মগুরুরা ছাড়া কেউ ধর্মগ্রন্থ পড়া তো দূরের কথা সাধারণ মানুষ বাইবেল স্পর্শও করতে পারত না। ধর্মগুরুরা যা বলত তা-ই ছিল ধর্ম। অসংখ্য নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয় ধর্ম অবমাননার দায়ে। উইচ হান্টের নামে হাজার হাজার নারীকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের French Revolution (1789-1799) মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় ধর্মের নামে যাজক শ্রেণির অত্যাচার-নিপীড়নের অন্ধকার যুগের।

লেখক : সজল রোশন

   


পাঠকের মন্তব্য