ঘন ঘন ভূমিকম্পে বিশেষজ্ঞদের মত | বিবিসি বাংলা

বাংলাদেশের সীমানার ভেতর বা আশপাশে

বাংলাদেশের সীমানার ভেতর বা আশপাশে

গত মে মাস থেকে চলতি মধ্য আগস্ট পর্যন্ত তিনবার ছোট থেকে মাঝারি আকারের যে ভূমিকম্প হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটিরই উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশের সীমানার ভেতর বা আশপাশে।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের পরস্পরমুখী গতির কারণেই এ ধরনের ভূমিকম্প হচ্ছে। এই দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে প্রচুর পরিমাণে শক্তি জমে রয়েছে যেগুলো বের হয়ে আসার পথ খুঁজছে। আর সে কারণেই ঘন ঘন এমন ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, দুদিন আগে বা পরে এই শক্তি বেরিয়ে আসবেই। আর সেটাই জানান দিচ্ছে এই ছোট ভূমিকম্পগুলো।

বাংলাদেশে সবশেষ ১৪ আগস্ট রাত ৮টা ৪৯ মিনিটের দিকে একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয় রাজধানীসহ দেশের বেশিরভাগ এলাকায়। মার্কিন ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী, এই ভূমিকম্পটির মাত্রা রিখটার স্কেলে ছিল ৫ দশমিক ৫ যা মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প। আর এর উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের সিলেটের কানাইঘাট এলাকায়। গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার। এর আগে, গত ১৬ জুন রাজধানীসহ সারা দেশে ৪ দশমিক ৫ মাত্রার মৃদু ভূমিকম্প হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের গোলাপগঞ্জ। আর চলতি বছরের মে মাসের ৫ তারিখে আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের হিসাব অনুযায়ী, এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩।

ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার কাছে বিক্রমপুরের দোহার থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। এটিরও গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, পার্বত্য এলাকায় ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মা প্লেট নামে দুটি টেকটনিক প্লেটের অবস্থান। এর মধ্যে ইন্ডিয়ান প্লেটটি উত্তর-পূর্ব দিকে এবং বার্মিজ প্লেটটি পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। ফলে মুখোমুখি সংঘর্ষ হচ্ছে। এই দুটি প্লেটের যে সংযোগস্থল সেটা বেশ গভীরে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার মতো উৎস হচ্ছে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত পার্বত্য এলাকা। এখান থেকে মণিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমারে যে পার্বত্য এলাকা রয়েছে সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কিশোরগঞ্জের হাওর দিয়ে মেঘনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে আন্দামানের পাশ দিয়ে দক্ষিণে যদি একটা রেখা কল্পনা করা যায়, এই এলাকাটা হচ্ছে দুটি টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থল। আর এই দুটি প্লেটের মধ্যে পূর্ব দিকেরটা হচ্ছে বার্মা প্লেট। আর পশ্চিমেরটা হচ্ছে ইন্ডিয়া প্লেট। এই সংযোগস্থলের ওপরের ভাগটা অর্থাৎ সুনামগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে পূর্বে মনিপুর, মিজোরাম পর্যন্ত এই অঞ্চলটি ‘লকড’ হয়ে গেছে অর্থাৎ এখানে শক্তি জমা হয়ে আছে।

দুটি প্লেটের যে সংযোগস্থল, সেটা এখানে স্যালো বা কম গভীর। অর্থাৎ পশ্চিমে পাঁচ কিলোমিটার থেকে শুরু করে পূর্বে ধীরে ধীরে এটা ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত গভীর হয়েছে।

ড. আখতারের মতে, ৮ দশমিক ২ থেকে শুরু করে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সংগঠনের মতো শক্তি এই এলাকায় জমা হয়ে আছে। এই শক্তি আজ হোক, কাল হোক বা আগামী ২৫ বছরেই হোক, এটা বের হতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। সেই বড় ভূমিকম্প যখন হবে তার আগের সময় এ ধরনের ছোট ভূমিকম্প দেখা যায় বলে মনে করেন তিনি। সেটা কয়েক বছর এমনকি ৫-১০ বছর ধরে হতে পারে।

তিনি বলেন, ‘গত চার-পাঁচ মাসে আমরা তিন-চারটি ভূমিকম্প দেখলাম। এই সবগুলোই হচ্ছে মৃদু থেকে মাঝারি ভূমিকম্প। এটা সাবডাকশন জোনের লকড সেগমেন্টে হচ্ছে।

এটার মানে হচ্ছে, বড় শক্তি বের হওয়ার একটা প্রবণতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তার মানে যেকোনো সময় একটি বড় ভূমিকম্প সংগঠিত হতে পারে। তবে এই বড় ভূমিকম্প কবে হবে সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।’

২০১৬ সালে প্রকাশিত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় একটি গোপন ফল্ট রয়েছে যা বাংলাদেশে ৯ মাত্রার মতো ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে।

এই প্রতিবেদনে গোপন এই ফল্টকে মেগাথার্স্ট ফল্ট নামে উল্লেখ করে বলা হয়, মাইলের পর মাইল বিস্তৃত পললের নিচে এই মেগাথার্স্ট অবস্থিত। এটি দুই প্লেটের সাবডাকশন জোন বা দুই প্লেটের সংযোগ স্থলে অবস্থিত এই মেগাথার্স্ট।

ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, বাংলাদেশে অসংখ্য ফল্ট রয়েছে। কিন্তু সেসব ফল্ট নিয়ে ভূতাত্ত্বিকরা খুব একটা চিন্তিত নয়। সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত দুই প্লেটের সংযোগস্থল। এ অঞ্চল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। দুই প্লেটের সংযোগ স্থলে যে ভূমিকম্প হয় তা খুবই ভয়াবহ।

ভূমিকম্পের জন্য পরিচিত রিং অব ফায়ার যেটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত সেটিও সাবডাকশন জোনের অন্তর্ভুক্ত। এই অঞ্চলে যে ভূমিকম্পগুলো হয় সেগুলোর বেশিরভাগই ৭ দশমিক ৫ এর ওপরে হয়ে থাকে। এগুলো শক্তিমত্তার দিক থেকে সব সময়ই ধ্বংসাত্মক। এ কারণে এই অঞ্চল নিয়ে চিন্তার বিষয় রয়েছে।

অনেকে মনে করেন যে, ঘন ঘন ছোট ছোট ভূমিকম্প হলে, ভূ-অভ্যন্তরে জমে থাকা শক্তি ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে আসে এবং এর ফলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা কমে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, এই ধারণাটি আসলে সত্য নয়। যে পরিমাণ শক্তি সাবডাকশন জোন বা দুই প্লেটের সংযোগস্থলে জমে থাকে তার পরিমাণ এতই বেশি যে, এটি বের হয়ে আসলে ৮ দশমিক ২ থেক ৯ মাত্রার মতো ভূমিকম্প হতে পারে।

ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, দৈনিক যদি ছোট থেকে মাঝারি আকারের ভূমিকম্প হয় তাহলেও এতো শক্তি বের হয়ে আসতে সময় লাগবে দুই থেকে তিনশ বছর। সূত্র : বিবিসি বাংলা

   


পাঠকের মন্তব্য