বাংলাদেশের উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মূল্যায়ন

বাংলাদেশের উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মূল্যায়ন

বাংলাদেশের উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মূল্যায়ন

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নামকরা অর্থনীতিবিদ যারা বাংলাদেশের উন্নয়নকে নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং এখনো পর্যবেক্ষণ করছেন তারা তাদের মূল্যায়ন প্রকাশ করেছেন নানাভাবে। এবারের প্রতিবেদনে আমরা জানবো সেসব মূল্যায়নের আংশিক অংশ। 

স্টিফান ডারকন : স্টিফান ডারকন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিক পলিসির অধ্যাপক। তিনি দীর্ঘ ১৬ বছর ব্রিটিশ বৈদেশিক সহায়তা সংস্থা ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টে (ডিএফআইডি) প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেছেন। সম্প্রতি তিনি একটি বই লিখেছেন, ‘গ্যাম্বলিং অন ডেভেলপমেন্ট: হোয়াই সাম কান্ট্রিজ উইন অ্যান্ড আদারস লুজ।’ এ বইয়ে একটি অধ্যায় রয়েছে বাংলাদেশকে নিয়ে যার নাম ‘দ্য বেঙ্গল টাইগার কাব’। এতে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ বিগত তিন দশকের মধ্যে উন্নয়নশীল বিশ্বে অন্যতম সফল গল্পগুলোর মধ্যে একটি। 

বাংলাদেশ কিছু ক্ষেত্রে অনেক ভালো করেছে, যেমন— যথার্থ সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি, স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, গার্মেন্টস শিল্প কিংবা প্রবাসে কর্মজীবী পাঠানোর সুযোগের ক্ষেত্রে বহির্মুখী প্রবণতাকে উৎসাহ দেওয়া। এর ফলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন সম্ভব হয়েছে। তিনি অধ্যায়ের শেষ বাক্যে বলেছেন, ‘হতে পারে আগামীতেও বাংলাদেশ আমাদের প্রতিনিয়ত অবাক করে দিতে থাকবে।’

অধ্যাপক কৌশিক বসু : কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক কৌশিক বসু বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ছিলেন। তাছাড়া তিনি ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। ডিপ্লোমেট ম্যাগাজিনের এক সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের উন্নয়ন মডেলকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কিত তৃণমূল পর্যায়ের মানব উন্নয়ন দ্বারা তাড়িত বলে অভিহিত করেছেন। অন্য একটি নিবন্ধে (২৫ মার্চ, ২০২১) উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ হেনরি কিসিঞ্জারের ‘বাস্কেট কেস’ থেকে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের কেস স্টাডিতে পরিণত হয়েছে। এ অর্থনৈতিক রূপান্তরের পেছনে অবশ্যই রাজনৈতিক উপাদান নিহিত রয়েছে। প্রগতিশীল সামাজিক নীতি ও কিছুটা ঐতিহাসিক ভাগ্য এ দুইয়ের ফলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দরিদ্র দেশ থেকে উদীয়মান ‘টাইগার’ অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের এশিয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও অপ্রত্যাশিত সাফল্য গাঁথা রয়েছে। 

অরবিন্দ সুব্রামানিয়ান : ভারতের আরো একজন নামি অর্থনীতিবিদ ব্রাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং ভারত সরকারের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরভিন্দ সুব্র্রামানিয়ান তার এক নিবন্ধে (১১ জুন, ২০২১) বাংলাদেশ মিরাকলকে প্যারাডক্স বা গোলকধাঁধা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার মতে, বাংলাদেশ দরিদ্র ও বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেলে পরিণত হয়েছে। তার ভাষায় বাংলাদেশ হলো মেঘনার মিরাকল।

বিশ্বব্যাংক : বিশ্বব্যাংক সময় সময় বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিয়ে মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়ন অগ্রগতির উদ্দীপক গল্প হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে ২০০০ সালের পর থেকে দারিদ্র্য অর্ধেকে নেমে এসেছে। দেড় দশকের এ সময়ে বাংলাদেশে আড়াই কোটির বেশি লোক দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতি শক্তিশালী ও প্রাণবন্ত রয়েছে। সব খাত দারিদ্র্য বিমোচনে কম বেশি ভূমিকা রেখেছে। দারিদ্র্য নিরসনের সঙ্গে সঙ্গে মানব পুঁজির উন্নয়ন ঘটেছে, জন্ম হার কমেছে ও প্রত্যাশিত গড় আয়ু এবং শিক্ষার হার বেড়েছে।

শি জিনপিং : চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মতে, বাংলাদেশের মানুষ পরিশ্রমী ও আত্মনির্ভরশীল। ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিগত পাঁচ দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটেছে এবং বৈশ্বিক দারিদ্র্যের ভাগ কমাতে সাহায্য করেছে। 

ফ্রাঙ্ক ওয়াল্টার স্টিনমিয়ার​​​​​​​: জার্মানির  প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক ওয়াল্টার স্টেইনমেইয়ারের ভাষায়, বর্তমান বাংলাদেশ হলো উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও গতিশীল গণতন্ত্রের দেশ। বাংলাদেশ উদ্ভাবনী উন্নয়ন নীতির মাধ্যমে দারিদ্র্য কমাতে সক্ষম হয়েছে।

বোস্টন কনসাল্টেটিভ গ্রুপ: আমেরিকার অন্যতম বৃহত্তম ব্যবস্থাপনা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বোস্টন কনসাল্টেটিভ গ্রুপের বাংলাদেশের ওপর বিশেষ প্রতিবেদন ‘দ্য ট্রিলিয়ন ডলার প্রাইজ’ ওপর আলোকপাত করে শেষ করতে চাই। ২০১৬-২১ এ সময়ে বাংলাদেশের গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, যা তার তুলনীয় দেশ ভিয়েতনাম, ভারত, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে অনেক বেশি ভালো করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে  ভোক্তাদের আশাবাদ, ভোগ বৃদ্ধি (বিশ্বের নবম ভোগ বাজার), তরুণ শ্রমশক্তি (জনসংখ্যার মধ্যমা বয়স ২৮), উচ্চ অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা, ডিজিটাল গতিবেগ (১৭৭ মিলিয়ন মোবাইল ব্যবহারকারী), সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি (বিগত দশকে তিন গুণ বেড়েছে), ব্যক্তি খাতে দ্রুত বৃদ্ধি, দ্রুত বর্ধনশীল গিগ অর্থনীতি (বিশ্বের মোট ফ্রিল্যান্সারের ১৫ শতাংশ)। বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ বলেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ১ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি ১০ শতাংশ হারে বাড়ে তাহলে ২০৩০ সালে, ৫ শতাংশ হারে বাড়লে ২০৪০ সালে ট্রিলিয়ন ডলারের বড় ইকোনমিতে পরিণত হবে। 

নিউজ-উইক: নিউইয়র্কভিত্তিক ম্যাগাজিন নিউজ-উইক বাংলাদেশকে নিয়ে কয়েকটি আলাদা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তার মধ্যে একটি হলো, ‘অদম্য বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের অগ্রগতি অসাধারণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, প্রক্ষেপণ থেকে দেখা যাচ্ছে এটা সবে শুরু। সাম্প্রতিক দশকে বাংলাদেশ যে অভাবনীয় অগ্রগতি লাভ করেছে তাতে অনেকে যারা এখনো অতীতের গণ্ডিতে আবদ্ধ তাদের বাস্তবতা মেনে পুনরায় চিন্তা করতে ম্যাগাজিনটি বলছে। অন্য আরো একটি প্রতিবেদনে ম্যাগাজিনটি বলছে, বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে অন্যতম গতিশীল ও সম্ভাবনাময়ী দেশ। ২০০৯ থেকে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দ্রুত রূপান্তর ঘটেছে এবং আগামী অর্ধশতাব্দীর মধ্যে বাংলাদেশের শুধু আঞ্চলিক পাওয়ারহাউজ নয় বরং বৈশ্বিক পাওয়ারহাউজ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০০৯-এর পর থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক গতি ২০৪০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। এ কথা বাহুল্য নয় কারণ চীন তিন দশক পর্যন্ত দুই অংকের প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। 

বাংলাদেশের উচ্চপ্রবৃদ্ধির পেছনে তিনটি ভিত্তি কাজ করেছে— রফতানি, সামাজিক খাতে অগ্রগতি ও আর্থিক দূরদর্শিতা। ২০১১-১৯ সময়ে বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল প্রতি বছর গড়ে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, অন্যদিকে গোটা বিশ্বে তা মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ঋণ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩০-৪০ শতাংশের মধ্যে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের  ক্ষেত্রে তা ৯০ শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনায় বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে ৭৫ শতাংশ বেশি ধনী ছিল, আর বাংলাদেশ এখন ৪৫ শতাংশ বেশি ধনী।

প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ অনুযায়ী অর্থনীতিকে আগামী দুই দশকে গড়ে ৯ শতাংশ হারে বাড়তে হবে। কভিড-১৯-এর পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না হলে হয়তো এখন প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশ বা তার কাছাকাছি থাকত। সে হিসেবে আমরা যদি বাস্তবিক প্রক্ষেপণ করি তাহলে ২০৩৪-৩৫ সালের মধ্যে আমরা ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হব নিশ্চিত।

   


পাঠকের মন্তব্য